ঢাকার একটি আদালতে রহস্যজনক আগুনে পুড়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত অনেক মামলার নথিপত্র। এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা, অনেকের সন্দেহ, এটি উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে। আদালত সংশ্লিষ্টরাও এই রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে চার সদদ্যের তদন্ত কমিটি।
আদালতপাড়ায় অগ্নিকাণ্ড ও মামলার নথি ধ্বংস হওয়া নতুন কিছু নয়। ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জানান, রেকর্ড রুমে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিটিকে। ১৬ নভেম্বর ২০২০, সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আদালত চলাকালেই মহানগর দায়রা জজ আদালতের দ্বিতীয় তলার ওই কক্ষে আগুন লাগে।
বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ সে সময় এজলাসে বিচার কাজ চালাচ্ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়। তবে ততক্ষণে অসংখ্য মামলার নথি পুড়ে যায় বলে সদরঘাট ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী জানান। ১৭ নভেম্বর বিচারক ইমরুল কায়েশ তদন্ত কমিটি গঠন করে তিন দিনের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন।
তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন, প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফয়সাল আতিক বিন কাদের। তার নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আরো আছেন ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. সালাউদ্দিন, গণপূর্তের সহকারী প্রকৌশলী সবুজ কুমার সান্যাল এবং ঢাকার মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারী।
আইনজীবীরা মনে করেন, রেকর্ড রুমে আগুন লাগার ঘটনা নথিপত্র নষ্ট করার উদ্দেশ্যেও হতে পারে। কারণ এর আগেও একটি দুটি নয়, এ ধরণের অনেক ঘটনাই ঘটেছে। এমনকি সুপ্রিমকোর্ট থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বহু মামলার নথি গায়েব হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এর বাইরেও জামিন নিয়ে কারচুপিসহ নানা ধরণের অনিয়মের ঘটনায় আদালত প্রশাসনের নাম জড়িয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে এমন শঙ্কা বিচারব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন আইনবিদরা।
সোমবারের আগুনের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির শাহ মো. মামুন জানান, এজলাসকক্ষের ওপরের সিলিংয়ে ২০০৯ সাল থেকে নিষ্পত্তি হওয়া পুরোনো বিবিধ মামলার কাগজপত্র রাখা হয়। সেখানে আগুন লেগে বেশ কিছু নিষ্পত্তি হওয়া নথি পুড়ে গেছে। বাকি নথি সেখান থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
অবশ্য অগ্নিকাণ্ডের সময় দায়িত্বরত কর্মকর্তারা এ ঘটোনাকে তুচ্ছ প্রমাণের চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, জলাসকক্ষের ওপরে রাখা বিবিধ মামলার কিছু কাগজপত্র পুড়ে গেছে। এসব কাগজপত্র মূল মামলার কোনো নথিপত্র নয়। অবশ্য সংশ্লিষ্টরা তা মানতে নারাজ। কারণ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া নথি বিচারপ্রাপ্তিতে নানাভাবেই বাধা হতে পারে। কারণ বিচারের ক্ষেত্রে কোনো কাগজই অগুরুত্বপূর্ণ নয়।
মামলার নথি ধ্বংস বা হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে বিচারিক ব্যবস্থার এক অন্যতম সমসস্যা। এ ধরণের ঘটনা মোটেও দুর্লভ নয়। জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি মহানগর দায়রা জজ আদালতের একটি আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যান রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। উচ্চ আদালতে তিনি নিজের পক্ষে রায় পান। কিন্তু তারপর থেকে এ স্থগিতাদেশের কোনো নথি আদালতে পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধান, অভিযোগ ইত্যাদির পরও কোনো হদিস মেলেনি ওই মামলার নথির।
আরেক ভুক্তভোগীর সিএমএম আদালতের একটি মামলার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশের নথি না পাওয়ায় পুনরায় মামলা চালু করে দিয়েছে সিএমএম আদালত। এ ধরনের ঘটনা অনেক। এভাবে বহু মানুষকে মানবাধিকার, এমনকি আইনের সুরক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। অনেক মামলা পড়ে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রের কবলে।
মহানগর দাইয়রা জজ আদালতের আইনজীবী আসিফ জোয়ার্দ্দার বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য এটা এক বড় অপবাদ। এমন ভোগান্তি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রায়শই উচ্চ আদালত সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে। ভুয়া আদেশে জামিন পাইয়ে দেয়া, বিচারপতিদের স্বাক্ষর জাল করে বিভিন্ন আদেশ ও কোনো ধরনের মামলা ছাড়াই নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে ভুয়া ওয়ারেন্ট জারি করে হয়রানি, অর্থ আদায় ইত্যাদি অভিযোগ কিন্তু আমরা সাম্প্রতিককালেই দেখেছি। এগুলো বন্ধে প্রধান বিচারপতিকে নতুন কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
আইনবিদরা মনে করেন, উচ্চ আদালতের মতো স্পর্শকাতর একটি জায়গায় এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এতে মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের উচিত এ সংক্রান্ত অভিযোগগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া। দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় আইনের শাসন ও আইনি প্রতিকারের মতো বিষয়ে মানুষের মনে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি হবে এবং আস্থা হারিয়ে যাবে।
মিই/আরা/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ