রাজধানীতে বারবার ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এতে প্রাণ যাচ্ছে বহু মানুষের। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভবনসংলগ্ন সড়কে যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১।
এ ঘটনার রেশ না কাটতেই একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৭ জনের মৃত্যু হয়।
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন রাত ৯টার দিকে রাজধানীর চানখাঁরপুলের নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় পাশের কেমিক্যালের গোডাউনে। ভয়ংকর সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হন ১২৪ জন। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা।
এ ছাড়া গত কয়েক বছরে বঙ্গবাজার, মগবাজার, নিউমার্কেটসহ ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার শেষ হয়নি। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে আগুনে বহু প্রাণহানির পর প্রশ্ন উঠেছে– এ ঘটনারও বিচার আদৌও হবে কি?
এসব ঘটনায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও মামলা-পরবর্তী বিচারেই থমকে আছে কার্যক্রম। এর মধ্যে নিমতলীর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাক্ষীর অভাবে বিচার শেষ হচ্ছে না। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো আসামির বা দোষীদের সাজা হয়নি।
মামলাসংশ্লিষ্ট নথিপত্র ও ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভবনগুলোতে বেআইনিভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এসব ঘটনায় ভবন মালিকসহ অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ডেভেলপার কোম্পানিসহ নানা সংস্থার সম্পৃক্ততা থাকে।
ফলে প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করার পাশাপাশি মামলার কার্যক্রমে আইনি মারপ্যাঁচে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেন তারা। এসব কারণে বড় দুর্ঘটনাগুলোতে মামলা হলেও তার বিচারে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
অবশ্য ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদের গ্রেপ্তার করা হয়; কিন্তু পরে তারা জামিনে বের হয়ে আসেন। এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, দু-একটি ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তবে আমাদের দেশে অগ্নি দুর্ঘটনায় অধিকাংশই ফৌজদারি মামলা হয়। এসব মামলায় আদালতে প্রমাণ করতে হয় অভিযুক্তরা হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উন্নত বিশ্বে এসব ঘটনায় এখন আর ফৌজদারি মামলা হয় না। সেখানে যারা মারা যান, তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি মামলা দায়ের করা হয়। দেওয়ানি মামলা প্রমাণ করাও সহজ এবং আইনত সঠিক।
তিনি আরও বলেন, মালিকের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের জরিমানা হলে বা এমন বিধান থাকলে, তিনি নিজেই অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন এবং ভবনের নকশা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব আইন মেনে চলবেন। কিন্তু আমরা এ ধরনের ঘটনায় ভুল পথে হাঁটছি। মালিক বা সংশ্লিষ্টদের এ ধরনের দুর্ঘটনার ঘটনায় জেল খাটানো ভুল পদক্ষেপ। জরিমানার দিকে হাঁটতে হবে। বড় অঙ্কের জরিমানার বিধান থাকলে অন্যরাও আইনি পথে আসবেন।
তাঁর মতে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় ফৌজদারি মামলা দায়েরের বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তারাও চান অভিযুক্তকে জেল খাটাতে। জেল খাটলে ক্ষতিগ্রস্তের কোনো লাভ হয় না। আর জরিমানার টাকাও সরকার পায়। তাই বিদ্যমান কাঠামো পরিবর্তন দরকার। তাহলে সাক্ষীরাও আদালতে সাক্ষী দিতে আগ্রহী হবেন।
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল সমকালকে বলেন, তদন্তে ত্রুটির পাশাপাশি পুলিশের সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার গাফিলতি রয়েছে। আদালতে তারা সাক্ষী হাজির করতে পারেন না। কারণ সাক্ষীদের অনেকেই ভাসমান থাকেন। বিচারের সময় তাদের পাওয়া যায় না। তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের। তারা যদি তদন্ত শেষ এবং সাক্ষী হাজির করতে না পারেন, তাহলে বিচার এগোবে কীভাবে? তাই অনেক মামলার বিচার তদন্তেই থমকে আছে।
নিমতলী ট্র্যাজেডি
২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর চানখাঁরপুলের নিমতলীতে ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণে অঙ্গার হয়ে যান ১২৪ জন। আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক। বহুল আলোচিত এ ঘটনায় কাউকে দোষী করা যায়নি। শনাক্তই করা যায়নি ওই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির জন্য দায়ী কারা। ফলে নিয়মিত মামলা দায়ের না হওয়ায় দায়ীদের বিচারের বিষয়টি আড়ালেই থেকে গেছে। নিমতলীর ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি নানা নির্দেশনা জারি হলেও তা কার্যকর হয়নি এখনও।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পাঁচ বছর পার হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। এখনও সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অনেক বাসার নিচে কেমিক্যালের গুদামও রয়েছে এবং পুরোদমে ব্যবসা চলছে। চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী কেমিক্যাল গোডাউনের (গুদাম) মালিকদের এখনও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্তও শেষ হয়নি।
পুলিশ বলছে, ভুল নাম-ঠিকানা দিয়ে চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভাড়া নিয়ে কেমিক্যালের গোডাউন স্থাপন করা হয়েছিল। সঠিক নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় তদন্ত শেষ করা যাচ্ছে না। ঘটনার পর ভবনের মূল মালিককে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন।
এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডি
বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৭ জনের প্রাণ হারানোর ঘটনায় ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ বনানী থানায় মামলা করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। তবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত হয়নি উল্লেখ করে পিবিআইকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম আটজনকে অভিযুক্ত করে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন, যেখানে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুলকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।
সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, রূপায়ণ গ্রুপ পজেশন হস্তান্তর করায় ভবনটির সুপারভাইজ ও ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায় না। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে নির্মাণ কোম্পানির কোনো অবহেলা পরিলক্ষিত হয়নি। এ ঘটনায় রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা জামিনে রয়েছেন। অথচ এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ভবনের অনুমোদন, নকশার ত্রুটি ও অগ্নিনিরাপত্তাকে দায়ী করা হয়েছিল।
ঘটনার পর নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনের তালিকা তৈরির কার্যক্রম শুরু করে রাজউক। কথা ছিল, সেই তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। ভেঙে ফেলা হবে সব নকশাবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনা। কিন্তু এসব কার্যক্রম থমকে আছে।
আলোচিত কয়েকটি মামলার বর্তমান অবস্থা
২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও এর কোনো বিচার হয়নি।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন। এ ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। বর্তমানে সোহেল রানা ছাড়া অন্য সব আসামি জামিনে মুক্ত। দুটি মামলার একটিরও বিচার শেষ হয়নি।
২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ পোশাক শ্রমিক পুড়ে মারা যান। আহত হন শতাধিক শ্রমিক। ২০১৩ সালে সিআইডি তাজরীনের এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বর্তমানে আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। সাক্ষী হাজির না করতে পারায় বারবার সময় নিচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় আগুনে ৪২ শ্রমিক প্রাণ হারান। ওই ঘটনায় পুলিশ এবং নিহত শ্রমিক জুয়েলের বাবা আবদুল কাদের পৃথক মামলা করেন। পুলিশের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনকে প্রধান করে ১০ জনকে আসামি করা হয়। আর নিহত শ্রমিক জুয়েলের বাবা আবদুল কাদেরের করা মামলার আসামি টাম্পাকো মালিকসহ আট কর্মকর্তা, যার বিচার এখনও চলছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ঢাকার বাইরে ছোটখাটো অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও তা আলোচনায় আসে না। মামলা হয়; কিন্তু কোনোটিরই বিচার হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, বেইলি রোড ট্র্যাজেডির জন্য শুধু ভবন মালিক নয়, সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থাকেও দায়ী করতে হবে। একটি ভবনে আটটি রেস্টুরেন্ট চলছে– সেটা কি সরকারি সংস্থাগুলোর অজানা ছিল?
অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ, কারখানা অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে হবে। তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত। শুধু মালিককে দায়ী করে সরকারি সংস্থাগুলো দায় এড়াতে পারে না।
আপনার মতামত জানানঃ