ইসরায়েলের জন্য ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে উঠেছে সাবেক ইসরায়েলি সেনা এবং খোদ ইহুদিরাই। সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের সহিংসতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির সাবেক এক শ’ সৈন্য। এদিকে প্রকাশিত এক গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদিরা ইসরায়েলকে বর্ণবাদী রাষ্ট্রি হিসেবে উল্লেখ করেছে। যা দেশটিতে গঠিত নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির জন্য বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এদিকে, বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী ইসরায়েলের দখলদারিত্বে ফলে ১ কোটি ৪০ লাখ ফিলিস্তিনি আজ শরণার্থী; যা গোটা বিশ্বকে আবারও ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে।
সাবেক ইসরায়েলি সৈন্যদের আহ্বান
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির সাবেক এক শ’ সৈন্য।
সম্প্রতি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তামন্ত্রী ওমের বার-লাভের কাছে পাঠানো চিঠিতে তারা এই আহ্বান জানান বলে ইসরায়েলি আর্মি রেডিওর বরাত দিয়ে বুধবার খবর জানায় তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি।
ইসরায়েলের বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব পালন শেষ করা এই সাবেক সৈন্যরা চিঠিতে বলেন, ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা প্রতিরোধের ভার এখন গান্টজ ও বার-লেভের হাতে রয়েছে। চিঠিতে তারা পশ্চিম তীরে তাদের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।
সাবেক সৈন্যরা তাদের চিঠিতে বলেন, ‘আমরা হচ্ছি ওই সব সৈনিক যারা ফিলিস্তিনিদের অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেছি, আমরা দেখেছি কিভাবে সহিংসতার ঘটনা ঘটে।’
‘আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে তাদের (ইহুদি বসতি স্থাপনকারী) রক্ষায় পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তাদের রক্ষা করায় আমাদের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।’
চিঠিতে বলা হয়, ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা সম্প্রতি চরমভাবে বাড়ছে। ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নষ্ট করছে ও পাথর ছুড়ছে, ফিলিস্তিনিদের শারীরিকভাবে হেনস্থা করছে। এছাড়া মানবাধিকারকর্মী ও ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালাচ্ছে বলে চিঠিতে জানানো হয়।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ৩৭০টির মতো সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছেন। এসব সহিংসতার ৪২টির মতো ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ইসরায়েলি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন এক কোটি ৩৮ লাখ ফিলিস্তিনি। গাজা ও পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি লোকসংখ্যা কমে এখন মাত্র ৫২ লাখ ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ধারণা অনুসারে বর্তমানে সাড়ে ছয় লাখের মতো ইহুদি বসতি স্থাপনকারী পশ্চিম তীরে ও জেরুসালেমে বাস করছেন। তারা ১৬৪ বসতি ও ১১৬ উপনিবেশে বাস করেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে সকল ইহুদি বসতি অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
১ কোটি ৩৮ লাখ ফিলিস্তিনি আজ শরণার্থী
ইসরায়েলি বর্বরতা ও দখলদারিত্বের কারণে নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন এক কোটি ৩৮ লাখ ফিলিস্তিনি।
ফিলিস্তিন সরকার সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য জানিয়ে গাজা ও পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি লোকসংখ্যা কমে এখন মাত্র ৫২ লাখ ৩০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। খবর আরব নিউজের।
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও ইউএনএফপিএ (ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ড) যৌথভাবে ওই পরিসংখ্যানের রিপোর্ট প্রকাশ করে।
অবরুদ্ধ গাজা ও পশ্চিমতীরের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশই শিশু। এদের মধ্যে গাজায় ৪১ শতাংশ বাসিন্দার বয়স ১৫ বছরের নিচে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গাজায় ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারে ২১ লাখ ১০ হাজার ফিলিস্তিনির বসবাস, যা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে অন্যতম।
জিউশ ইলেকটোরেট ইনস্টিটিউটের এক জরিপে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ ইহুদির চোখে ইসরায়েল একটি ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’। এ ছাড়া ২২ শতাংশ মনে করেন ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
সূত্র মতে, জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন ছাড়াও বহু ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন লাতিন আমেরিকার দেশ চিলিতে। সেখানে এ বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করছেন এক ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত নাগরিক।
ইসরায়লের বিপক্ষে ইহুদিদের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৪ শতাংশ ইহুদি মনে করেন ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের আচরণ আমেরিকার বর্ণবাদের মতই। গত মঙ্গলবার একটি জরিপের ফলের ওপর ভিত্তি করে এ তথ্য জানায় লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আই। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের পর এ জরিপ চালানো হয়।
জিউশ ইলেকটোরেট ইনস্টিটিউট ২৮ জুন থেকে ১ জুলাইয়ের মধ্যে এ জরিপ চালিয়েছে, যা প্রকাশ করেছে ১৩ জুলাই। জরিপে অংশ নিয়েছেন ৮শ জন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৩৪ শতাংশ ইহুদি মনে করেন ‘ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের আচরণ আমেরিকায় চলা বর্ণবাদের মতোই’।
জরিপে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ ইহুদির চোখে ইসরায়েল একটি ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’। এ ছাড়া ২২ শতাংশ মনে করেন ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরাইয়েলি গবেষণা সংস্থা, ‘ক্যান্টোর সেন্টার’ এর এক রিপোর্টে জানায়, করোনা মহামারী চলাকালে, বিশ্বজুড়ে ইহুদি বিরোধী সহিংসতার মাত্রা কমে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়I গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি বিরোধী ১১৯টি ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছেI
ইসরায়েলের পরেই বৃহত্তর এক ইহুদি জনগোষ্ঠীর বসবাস এই যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে ৪০ লক্ষ ২০ হাজার ইহুদি আমেরিকান জনগণ বসবাস করছেন, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে তাদেরকে ভয়-ভীতির মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।
এদিকে নভেম্বর, ২০১৯ থেকে জুন, ২০২০ অব্দি সময়জুড়ে পিউ রিসার্চ সেন্টারের দ্বারা করা এক সমীক্ষায় জানা যায়, ৪৫% আমেরিকান ইহুদিরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য ইসরায়েলকে প্রয়োজনীয় মনে করেন এবং ৩৭% ইহুদি ইসরায়েলকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেও প্রয়োজনীয় মনে করেন না। এদিকে, ১৬% ইহুদি তাদের পরিচয়ের জন্য ইসরায়েলকে গুরুত্বপূর্ণই মনে করেন না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬১৭
আপনার মতামত জানানঃ