বুলিং এবং বডিশেমিং মূলত শরীরের গঠন এবং রঙ নিয়ে ব্যঙ্গ করা, এর জন্য ব্যক্তিটি হীনমন্যতায় ভোগে। ব্যঙ্গ করার অভ্যাস একটি সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যার কবলে পড়ে হাজার হাজার তরুণ তরুণী মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। এজন্য ব্যঙ্গ করার ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সাথে দেখে এটি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সরকারিভাবে স্কুল কলেজগুলোতে এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বুলিংয়ের ব্যাপারে আলোচনা করা জরুরি।
গত বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) অ্যানোরেক্সিয়া এবং বুলিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক কিশোরের মৃত্যুর পর তার পরিবার থেকে অভিযোগ উঠেছে, ছেলেটি মোটা হবার দরুণ স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিং এর শিকার হবার ফলস্বরূপ এই ঘটনা ঘটেছে। মৃত ছেলেটি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখায় দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল।
কিশোরের বাবা মোঃ ফজলুল করিম গণমাধ্যমকে জানান, ২০২০ সালের জুন-জুলাইতে তার সন্তানের ওজন ছিল ৯৩ কেজি। এরপর জুলাই মাসের দিকে সে খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ডিসেম্বরে ছেলেটির ওজন দাঁড়ায় ৬০ কেজি। তারা ভেবেছিল স্বাভাবিক নিয়মে ওজন কমছে ছেলেটির।
জানুয়ারির শেষ দিকে ছেলেটির শারীরিক কিছু পরিবর্তন নজরে আসে সবার। তার পায়ের গোড়ালি ফুলে গিয়েছিল, তার আচরণ আর আগের মত প্রাণচাঞ্চল্যকর এবং স্বাভাবিক ছিল না, সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত।
এজন্য ফেব্রুয়ারিতে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে ছেলেটি প্রথম জানায়, সে ইন্টারনেট থেকে একটি জনপ্রিয় ডায়েট প্রোগ্রাম অনুসরণ করে ওজন কমাচ্ছিল। ওই সময়েই তার একটি মানসিক পরিবর্তনও হচ্ছিল।
কোন এক বেলায় সামান্য বেশি খেলেই বাথরুমে গিয়ে বমি করে ফেলত ছেলেটি। ওই সময়টাতে সে খেতে ভয় পেত। আবার যদি তার ওজন বেড়ে যায়, তাহলে আবার স্কুলে সবাই তাকে ক্ষেপাবে এমন একটি ভয় চেপে বসেছিল তার মনে, সেটা সে ডাক্তারের কাছে স্বীকার করেছিল।
এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলেটিকে একইসঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ডায়েটিশিয়ান, সাইেকালজিস্ট এবং সাইক্রিয়াটিস্টের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেয়া শুরু হয়। কিন্তু ততদিনে তার ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে কমে যায় এবং সেই সঙ্গে তার ওজনও দ্রুত কমে যাচ্ছিল।
মে মাসের দিকে তার ওজন দাঁড়ায় ২৯ কেজিতে। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, ছেলেটি অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা নামে একটি অসুখে ভুগছে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য বিভাগ এনএইচএস বলছে, অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা আহার সংক্রান্ত একটি ব্যাধি, যা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির মধ্যে মানসিক সমস্যাও তৈরি করে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি না খেয়ে থেকে অথবা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খেয়ে ওজন কমাতে চান এবং ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে ভীতিতে ভোগেন।
অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা আহার সংক্রান্ত একটি ব্যাধি, যা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির মধ্যে মানসিক সমস্যাও তৈরি করে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি না খেয়ে থেকে অথবা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খেয়ে ওজন কমাতে চান এবং ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে ভীতিতে ভোগেন।
গত ২৫শে জুন রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল ছেলেটিকে। পরদিন রাত ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।
পরিসংখ্যান বলছে, কৈশোর-তারুণ্যে আত্মহত্যা হচ্ছে বিশ্বে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। প্রতি ১০ মিনিটে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও একজন কিশোর/কিশোরী সহিংসতার কারণে মারা যায় (ইউনাইটেড ন্যাশনস চিলড্রেন ফান্ড); ৮৩ শতাংশ তরুণ মনে করে, বুলিং বা খ্যাপানো তাদের আত্মমর্যাদার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে (ডিসথেলেবল ডট অরগ)।
বছরে ১বার করে হলেও বাংলাদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য কেবল শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলে তা হতাশাজনক। পড়ালেখার বাইরে গিয়েও আরও অনেক আলোচনা এবং প্রশিক্ষণ দেবার জায়গা আছে যা আসলে বিশেষ প্রয়োজনীয়।
কিশোর-কিশোরী বয়সে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক আচরণ করছে কি না, কিংবা কেউ বুলিংয়ের শিকার হয়ে মানসিক বিপর্যয়ে ভুগছে কি না বা কেউ বুলিং করছে কি না এসব বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া সরকারি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে আরও দরকার অভিভাবকের সচেতন থাকা। কারও সন্তান বুলিং করছে কি না বা কারও সন্তান বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে কি না উভয় দিকেই নজর রাখা দরকার। কারও শারীরিক গঠন, রঙ বা স্বভাব নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কথা বলা যে অপরাধ, তা সন্তানকে ছোট থেকেই বোঝানো জরুরি।
আর এসব ক্ষেত্রে সরকারের নিষ্পৃহতা আরও বাজে বার্তা দেয়। বডিশেমিং বা বুলিং এর বিষয়ে স্কুল কলেজগুলোতে সরকারের হস্তক্ষেপহীনতা একদিকে যেমন নিন্দনীয় অন্যদিকে সমস্যাটি বৃদ্ধির কারণও। সরকারের উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বডিশেমিং বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া। শিক্ষক কিংবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে আইনি নিয়ম চালু করা। সমস্যাটি রোধে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে একটি কাঠামো দাঁড় করা যাতে ওই কিশোরের মত আর কোনো প্রাণ ঝরে না পড়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৮৩৩
আপনার মতামত জানানঃ