যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার(৮ জুলাই) প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এই মন্তব্য করা হয়েছে।
‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি: দ্য ২০২০ ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মোকাবিলা নিয়ে সরকারের সমালোচনা ঠেকাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগসহ গণমাধ্যমের ওপর আরও বিধিনিষেধ এবং নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর অব্যাহত সহিংসতা যুক্তরাজ্যের উদ্বেগের বড় জায়গা।
২০২০ সালেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম চাপের মধ্যে ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার-হয়রানির কথাও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৫১তম স্থানে নেমে এসেছে, যা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বনিম্ন অবস্থান।
‘আর্টিকেল ১৯’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৫১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। ৪১টি মামলায় ৭৫ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ৩২ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই আইনে যারা সরকারের করোনা মোকাবিলা ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করেছে তেমন ৪০০ এর অধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, আওয়ামী লীগের এক নেতার পতিতাবৃত্তির সিন্ডিকেট নিয়ে অনুসন্ধান করায় এক সাংবাদিককে ৫৩ দিন গুম করে রাখা হয় এবং পরে তার সন্ধান মিলে ভারত সীমান্তে।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে ৬৭ টির মতো হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুরা তাদের জমি দখলের অভিযোগ করেছেন।
৪৫১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। ৪১টি মামলায় ৭৫ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ৩২ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই আইনে যারা সরকারের করোনা মোকাবিলা ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করেছে তেমন ৪০০ এর অধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নারীদের উপর সহিংসতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের উপর সহিংসতা এখনও একটি বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে গত এক বছরে ১৬২৭ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ব্যবস্থার ঘাটতিকে দুষছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাসান চরে নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা যাচাইয়ে জাতিসংঘের টেকনিক্যাল কমিটির মূল্যায়ন নিতে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য অংশীদার দেশগুলো তাদের আহবান অব্যাহত রাখবে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রিত করায় কোভিড চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবিক কাজ পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি করার অধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করে যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলা এবং ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর ব্যাপক অভিযোগ ছিল। ওই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করায় সরকার যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনসহ অন্যান্য কূটনৈতিক মিশনের সমালোচনা করে। গত নভেম্বর মাসে উপনির্বাচনে ভোটারদের হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার আরো ঘটনা ঘটে।
এ দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্য তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ক্রসফায়ার, নির্যাতনসহ ২২৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দায়ী। গত বছরের আগস্ট মাসে পুলিশের হাতে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা জনগণের কাছে নজিরবিহীন গুরুত্ব পায়। এরপর বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমেছে। অন্তত ৩১টি গুমের তথ্যও আছে ওই প্রতিবেদনে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে গত বছর মার্চ মাসে মুক্তি দিয়েছিল সরকার। শর্ত ছিল তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না। এর পর থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া বাকি সময়টা গুলশানে তার ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’তেই অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে খালেদা জিয়ার ওই বাসায় অবস্থানকে ‘হাউস অ্যারেস্ট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের মার্চ মাসে সরকার খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া ও বিদেশে না যাওয়ার শর্তে তাকে মুক্তি দেয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে তার কারাদণ্ডাদেশ স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২০ সালজুড়েই তিনি ‘হাউস অ্যারেস্ট’ ছিলেন।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ। অন্য দুটি হলো নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা বা সংসদ। একটি ভালো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা-ই, যেখানে তিনটি বিভাগই সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে এবং থাকবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগের বাইরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ রয়েছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা অস্বীকার করে না কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
তারা বলেন, আমাদের দেশে সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ বিভিন্ন দিক থেকে আসে। কোনো সংবাদ, তা যতই জনস্বার্থের পক্ষে হোক, কারও স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই সাংবাদিকদের আসামি করা হয়। সংবাদ বা প্রতিবেদন ভুল বা মিথ্যা হলে তা সংশোধনযোগ্য। প্রতিবাদের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু আজকাল সাংবাদিকদের হয়রানি করতে ফৌজদারি মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। অভিযোগ নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত না করিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে থাকে। সম্পাদক ও সাংবাদিকদের নাকে দড়ি দিয়ে দেশব্যাপী ঘোরানো হয়। অর্থাৎ অভিযোগ প্রমাণের আগেই শাস্তি।
তারা বলেন, কথায় কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে মামলা, মানহানির মামলা বা আদালত অবমাননার মামলা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাউকে অসম্মান বা অমর্যাদা করাকে সমর্থন করতে পারে না। আদালতের মর্যাদা সমুন্নত রাখা নাগরিকদের কর্তব্য। নির্বাহী ও আইনপ্রণেতাদেরও দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের ও নাগরিক সমাজের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে না দেওয়া।
তারা বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার যেখানে স্বীকৃত, সেখানে তার অপব্যবহার হতেও পারে। তবু সেই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের কথা স্মরণ করতে পারি: ‘জনগণের ইচ্ছাই যেকোনো সরকারের একমাত্র বৈধ ভিত্তি; আর আমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ