দামে সস্তা। অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলিতে এই টিকা সিনোভ্যাক দেয়া হচ্ছে। মজুত করা সহজ। ফাইজারের মতো কম তাপমাত্রায় রাখার প্রয়োজন হয় না। এদিকে, বাংলাদেশ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে সিনোভ্যাক টিকার উপর। সম্প্রতি দেশে উৎপাদনের বিষয়েও আলাপ আলোচনা চলছে। তবে এই টিকা কতটা কার্যকর তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় এই টিকা নেয়ার পরও ডাক্তার ও নার্সদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদিকে, ডাব্লিউএইচও জানিয়েছে, সিনোভ্যাক টিকার সমস্ত রকম পরীক্ষা করা হয়েছে। ৫১ থেকে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর এই টিকা।
সিনোভ্যাক নিয়েও মারা যাচ্ছে রোগী
ইন্দোনেশিয়ায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জন চিকিৎসক এবং ১০ জন নার্স কোভিডে ভুগে মারা গেছেন। দেশটির ডাক্তার ও নার্স সমিতি বলছে, মৃতদের সবারই চীনে তৈরি সিনোভ্যাক টিকা নেয়া ছিল।
ইন্দোনেশিয়ায় এখন যেভাবে বিপজ্জনক মাত্রায় সংক্রমণ এবং মৃত্যু বাড়ছে তাতে অনেক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছেন দ্রুত যেন সমস্ত ডাক্তার, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্য-কর্মীদের একটি বুস্টার ডোজ অর্থাৎ সিনোভ্যাকের তৃতীয় একটি ডোজ দেয়া হয়।
ইন্দোনেশিয়ার ২৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে আট শতাংশেরও কম লোক টিকা পেয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি নানা ধরণের করোনাভাইরাস বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে সংক্রমণের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। সেইসাথে সন্ত্রস্ত মানুষজন টিকা নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছেন।
ইন্দোনেশিয়াতে বর্তমানে প্রতিদিন ২০ হাজারেরও বেশি নতুন কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই হিসাবের চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি কারণ রাজধানী জাকার্তার বাইরে কোভিডের পরীক্ষার সুযোগ সীমিত। তবে টিকা পেলেও চীনের তৈরি সিনোভ্যাক আসলে কতটা সুরক্ষা দিতে পারছে বা পারবে তা নিয়ে ইন্দোনেশিয়াতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
সেদেশে এখন পর্যন্ত একমাত্র সিনোভ্যাকের তৈরি টিকা দেয়া হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত কোভিডে ভুগে ৯৪৯ জন স্বাস্থ্য কর্মী মারা গেছেন। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন ডাক্তার এবং ১০ জন নার্সের সিনোভ্যাক টিকা নেয়া ছিল।
ডাক্তাররা এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে চাননা, কিন্তু তারা স্বীকার করেন তারা নিরাপদ বোধ করছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফুসফুস বিশেষজ্ঞ জানান, সিনোভ্যাকের দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার এক মাস পর তিনি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখেন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো সুরক্ষাই দেহে তৈরি হয়নি।
‘কোন কাজই হয়নি। এই টিকা আমার শরীরে কোনো অ্যান্টিবডি (প্রতিরোধ শক্তি) তৈরি করেনি’, বিবিসি ইন্দোনেশিয়া সার্ভিসকে বলেন ঐ চিকিৎসক। আরো একমাস পর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করেও তিনি একই ফল পান।
তবে ঐ চিকিৎসক বলেন, তার কিছু সহকর্মী ভালো ফল পেয়েছেন, কিন্তু তার শরীরে সিনোভ্যাক টিকা কোনো কাজ করেনি।
সিনোভ্যাকের উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশ
গত ৬ জুন চীনের টিকা সিনোভ্যাক বাংলাদেশে জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। রোববার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান অনুমোদনে স্বাক্ষর করেন।
এরপর জুলাইয়ের ১ তারিখে পহেলা জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ সারা দেশে আবারও করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এবারে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে চীনের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের টিকা সিনোভ্যাক দেয়া হচ্ছে।
সূত্র মতে, চীন থেকে মে ও জুন মাসের মাঝামাঝি দুই দফায় সিনোফার্মের মোট ১১ লাখ টিকা বাংলাদেশে আসে। ২৫শে মে থেকে শুরু হয় সিনোফার্মের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ।
সিনোফার্মের কাছ থেকে সরকারি পর্যায়ে দেড় কোটি টাকার টিকা কেনার চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী জুন জুলাই ও অগাস্ট মাসে ৫০ লাখ করে মোট দেড় কোটি টিকা আসার কথা।
কী বলছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ব্যবহারের জন্য সিনোভ্যাক টিকা অনুমোদন করেছে। ডব্লিউএইচও অনুমোদনের সময় জানিয়েছিল, সিনোভ্যাক কোভিডের বিরুদ্ধে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দেয় বলে পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আরো বলেছিল, পরীক্ষায় একশ ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সিনোভ্যাক টিকা কোভিডের বিপজ্জনক উপসর্গ এবং হাসপাতালে ভর্তি ঠেকাতে কাজ করেছে।
চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানি, যারা এই টিকা তৈরি করছে, দাবি করছে তাদের টিকার দুই ডোজ নিলে কোভিডের বিপজ্জনক উপসর্গ থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে।
কোম্পানি বলছে, তৃতীয় ডোজ নেওয়ার প্রতিক্রিয়া নিয়ে এখন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হচ্ছে এবং প্রাথমিক ফলাফল ‘আশাব্যঞ্জক’।
সিনোভ্যাকের প্রধান নির্বাহী ইন উইডং সম্প্রতি চীনা টিভি নেটওয়ার্ক সিটিভিকে বলেন, দুই ডোজ নেয়ার পর শরীরে প্রতিরোধী শক্তি তৈরি হচ্ছে। তৃতীয় ডোজ প্রয়োজন কিনা তা পরীক্ষার জন্য দয়া করে গবেষকদের আরো কিছুটা সময় দিন।
তৃতীয় ডোজ নিয়ে পরীক্ষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার তিন থেকে ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ নেয়ার পর দেহে অ্যান্টিবডির শক্তির মাত্রা ১০ গুণ বেড়ে যেতে পারে, ১৫ দিনের মধ্যে নিলে, সেই মাত্রা ৩০ গুণ বাড়তে পারে।
চীনের সাথে যৌথ টিকা উৎপাদন
আজ মঙ্গলবার (৬ জুলাই) চীনের ডেপুটি চিফ অব মিশন হুয়ালং ইয়ান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বার্তায় জানান, করোনাভাইরাসের টিকার যৌথ উৎপাদনে চীনা কোম্পানি আর অ্যান্ড ডি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে।
হুয়ালং ইয়ান লেখেন, চীনা কোম্পানি আর অ্যান্ড ডি সংস্থা ভবিষ্যতে টিকা উৎপাদনে বাংলাদেশি অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করবে। চীন এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি দেশে টিকা সরবরাহ করেছে। কোভ্যাক্সকে ১০ মিলিয়ন ডোজ টিকার প্রথম ব্যাচ সরবরাহ করবে। চীন বহু উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন ও সমবায় উৎপাদন পরিচালনা করেছে এবং তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনায় বিদেশি দেশগুলোকে সহযোগিতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সমর্থন করেছে।
গত ২১ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সেদিন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে করোনার টিকার যৌথ উৎপাদনে চীনা কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করা হবে।
এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের করোনা টিকার যৌথ উৎপাদনের অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র উল্লেখ করে বলেন, চীন বাংলাদেশে করোনার টিকার যৌথ উৎপাদনে সে দেশের কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ