ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলের ব্যস্ততম একটি এলাকায় সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ বিমান হামলা হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত আরও অনেক। এখনও ৩৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। মঙ্গলবার প্রদেশের তোগোগা শহরের একটি মার্কেটে সামরিক বাহিনীর বিমান বোমা ফেলেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ, সেনাবাহিনীর সদস্যরা মেডিকেল টিমকে ঘটনাস্থলে যেতে দিচ্ছে না।
আহতদের তাইগ্রের প্রাদেশিক রাজধানী মেকেলের আয়দার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসক ও নার্সদের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়, বিমান থেকে তোগোগার ব্যস্ততম বাজার এলাকায় বোমা ফেলা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আঞ্চলিক রাজধানী মেকেল্লেতে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নতুন করে লড়াই শুরু হয়েছে। হর্ন অব আফ্রিকার দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল গেটনেট আদানি এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার কিংবা অস্বীকার করেননি।
তিনি বলেন, বিমান হামলা একটি সাধারণ সামরিক কৌশল। তবে বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে না সরকারি বাহিনী।
তোগোগা শহরের এক নারী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুর ১ টার দিকে এই হামলা হয়েছে। হামলার সময় স্বামী ও মেয়েসহ সেই মার্কেটে ছিলেন তিনি। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও তার স্বামী ও মেয়ে- দুজনেই আহত হয়েছেন।
বুধবার রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো প্লেন দেখিনি, কিন্তু ওই মার্কেটের ওপর যখন বোমা পড়ল, সবাই ছুটে মার্কেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই ফিরে আসি এবং আহতদের উদ্ধার করা শুরু করি।’
ওই নারী যদিও বলেছেন, হামলার সময় মার্কেটটিতে প্রচুরসংখ্যক মানুষ ছিল এবং তাদের অনেকেই মারা গেছে, কিন্তু তার কথা যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স। সরকারি বাহিনীর হামলার ভয়ে তিনি এবং অন্যান্য ভুক্তভোগীরা রয়টার্সকে নিজেদের নামও জানাননি।
শহরের প্রধান হাসপাতালের একজন নির্বাহী কর্মকর্তা রয়টার্সকে মৃতের সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন। পাশাপাশি বলেছেন, দ্রুত এই সংখ্যা আরও বাড়বে; কারণ শহরের প্রধান সড়কটি অবরোধ করে রেখেছে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। অ্যাম্বুলেন্স বা কোনো ধরনের যানবাহন ওই সড়কে চলতে দেখলেই হেনস্তা করা হচ্ছে।
হাসপাতালের ওই নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দু’টি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর জন্য ঘুরপথে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে তারা আটকা পড়েছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে যথেষ্ট চিকিৎসা উপকরণও নেই। তাই খুব দ্রুত মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
গেতনেত আদানে অবশ্য বলেছেন, সামরিক বাহিনী কোনো সড়ক অবরোধ করেনি।
এর আগে ইথিওপিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র হামলার এক ঘটনায় শিশুসহ ৮০ জনের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। পশ্চিমাঞ্চলীয় বেনিসাংগুল-গুমুজের ড্যালেট্টি এলাকায় এই হামলা চালানো হয়।
তার আগে গত ২৩ ডিসেম্বর একটি হামলাতেই ২০৭ জন নিহত হন।
পূর্ব আফ্রিকার দরিদ্র দেশ ইথিওপিয়ার তাইগ্রে প্রদেশে দেশটির সামরিক বাহিনী ও তাইগ্রের সাবেক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ)-এর মধ্যে সংঘাত শুরু হয় গত বছর নভেম্বর থেকে।
৫০ লাখ মানুষের পার্বত্য প্রদেশ তাইগ্রেতে চলমান এই সংঘাতে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, গৃহহীন হয়েছেন অন্তত কয়েক লাখ।
বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব ঘেন্টের একদল গবেষক ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য প্রদেশ তাইগ্রের সংঘাত নিয়ে গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা তাইগ্রেতে অন্তত ১৫০ টি গণহত্যা চালিয়েছেন; এবং এই গণহত্যায় নিহত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার মানুষ। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী-শিশু ছাড়া ৯০ এর অধিক বয়সী বৃদ্ধও আছেন। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যার সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড এটি।
২০২০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আবি আহমেদকে এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা বলে মনে করা হয়। গত বছরের নভেম্বরে তাইগ্রেতে ইথিওপিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে আকস্মিক হামলা হয়। হামলার পর দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় এই প্রদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টকে (টিপিএলএফ) ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে আইনের শাসন ফেরাতে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন আবি আহমেদ।
অবশ্য আবি আহমেদের দাবি, বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অতিরঞ্জিত। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহীদের সংঘাতে বর্তমানে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি চলছে তাইগ্রেতে।
১৯৯১ সালে টিপিএলএফের নেতৃত্বে ইথিওপিয়া থেকে সামরিক সরকার উৎখাত করা হয়। ২০১৮ সালে আবি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগপর্যন্ত দেশটির রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ছিল এ গোষ্ঠীর। তবে এরপর থেকে গোষ্ঠীটির নেতারা অভিযোগ করে আসছেন, আবি তাদের এড়িয়ে চলেছেন। দেশের দুর্দশাময় পরিস্থিতির জন্যও আবি সরকারকে অভিযুক্ত করেন তারা। আর তখন থেকেই শুরু আঞ্চলিক নেতৃত্ব ও ফেডারেল সরকারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ