বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৯ জনের মামলা নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে গত দুই দশকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান এবং দণ্ড কার্যকরের সংখ্যা বেড়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বেশির ভাগ দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। এ সময়ে প্রাণদণ্ড পাওয়া বন্দিদের মধ্যে ৭২ শতাংশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। আর ৫৩ শতাংশ অপরাধ সংঘটনের সময় স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন বা বেকার ছিলেন।
বৃহস্পতিবার রাতে ভার্চ্যুয়াল এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে করা এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের উদ্যোগে ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সহযোগিতায় গবেষণাটি হয়েছে। দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধানে ‘মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় বসবাস’ শীর্ষক এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণা প্রবন্ধ তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তার নেতৃত্বে গবেষণাটি হয়েছে। গবেষণার সময়কাল ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত।
কী উল্লেখ আছে গবেষণায়?
গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১ জন, ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৫৭ জন এবং ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ৪৬ শতাংশ মামলায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনার তারিখ থেকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি হতে ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। হাইকোর্ট বিভাগে মামলা গড়ে নিষ্পত্তি হতে সাড়ে পাঁচ বছর সময় লেগেছে
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ৩১ বছরে হত্যা ও সন্ত্রাসবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত ১০১ জন আসামির ফাঁসি (মৃত্যুদণ্ড) কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১ জন এবং ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ৫৭ জন ও ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩৩ জন বন্দির মৃত্যুদণ্ড দেশের বিভিন্ন কারাগারে কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন কারাগারে আরও এক হাজার ৬৫০ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, সাধারণ আইনে ৩৩টি অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। এর মধ্যে ১৪টি বিধান ২০০০ সালের পর যুক্ত হয়েছে। ২০১৩ সালে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৯ জনকে নিয়ে এই গবেষণা হয়েছে। ওই ৩৯ জনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি পরিবার সামাজিকভাবে বিভিন্ন রকম হয়রানির শিকারও হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বেশ কয়েকটি ফাঁসি কার্যকর করা হয় এবং শতাব্দীর শুরু থেকেই এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ ছাড়া এসব অপরাধ সংঘটনের সময় ৫৪ শতাংশ অপরাধী বিবাহিত ছিলেন এবং ৩৩ শতাংশ বন্দির সন্তান ছিল। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি আসামিদের মধ্যে পুরুষ ৯৭ শতাংশ, যা বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মধ্যে একজন নারী বন্দি আসামি থাকলেও হাইকোর্ট তার শাস্তি নিশ্চিত করেননি। ৯৫ শতাংশ বন্দি হত্যার দায়ে এবং ৫ শতাংশ বন্দির শাস্তি হয়েছিল সন্ত্রাসের দায়ে। বেশিরভাগ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি স্বল্পশিক্ষিত।
গবেষণায় বলা হয়, ৭৪ শতাংশ বন্দির অপরাধের সময় বয়স ছিল ৩০ বছরের কম। বেশিরভাগ অপরাধীর বয়স ছিল ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ বন্দি স্কুল পার হতে পারেনি এবং ১৫ শতাংশ বন্দির কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। এ ছাড়া আসামিদের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়েছে, অনিশ্চিত আর্থিক অবস্থা সত্ত্বেও বন্দিদের পরিবারের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, প্রতিরক্ষা বাহিনী-সংক্রান্ত আইন এবং একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ সম্পর্কিত আইন ব্যতীত বাংলাদেশে ৩৩ ধরনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি অপরাধ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে, একটি পাকিস্তান আমলে এবং ২৩টি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রণয়ন করা হয়।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে বলে মত দেন। একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ও সামাজিক অভিঘাত নিয়ে গবেষণা, আলোচনা ও বিতর্কের ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, ‘লোকেরা মনে করে মৃত্যুদণ্ডে অবৈধ কাজ কমায়। আমি তা মনে করি না। মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও অপরাধ হয়, না থাকলেও হয়। এটি কমানোর জন্য সামাজিক সচেতনতা দরকার। কোনো অপরাধ হলে ‘ন্যায়বিচার’ চাই বলে দাবি ওঠে। ফাঁসি চাই বলা হয়। মৃত্যুদণ্ড হলেই ন্যায়বিচার হয়েছে বলা যায়? এটি ভয়াবহ অবস্থা, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে যাদের সাজা হয়েছে বা কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় আছে, তাদের বেশির ভাগ গরিব ও শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত। শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি আইনের সংস্কার প্রয়োজন। মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে আরও বেশি গবেষণা, আলোচনা ও পর্যালোচনা হওয়া দরকার।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বিশ্বজুড়েই মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড বিধান ১০৮টি দেশে বিলুপ্ত করা হয়েছে। দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা কার্যকরে অনেক সময় লাগে। ১৫-২০ বছর পর্যন্ত দণ্ডিত ব্যক্তিকে এ জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এটি তার জন্য বাড়তি শাস্তি হয়ে যায়। মৃত্যুদণ্ডের বিধান পরিবর্তনের বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ, ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী সারা হোসেন, অধ্যাপক নাইমা হক, বাংলাদেশে সুইডিশ দূতাবাসের (কাউন্সিলর-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রধান) থমাস বামগার্টনার, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনের রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান আবু জাকি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যুদণ্ডবিষয়ক গবেষণা ইউনিটের পরিচালক ক্যারোলিন হল।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ