ইরানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ইরানে দুই অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও ১২ জন নারীসহ কমপক্ষে ৪২৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আর এসব মৃত্যুদণ্ডের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সুন্নী মতাদর্শী বেলুচরা। ২০২২ সালে অন্তত ১২১ জন বেলুচ নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা সব মৃত্যুদণ্ডের ৩৫ শতাংশ।
নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটস এ তথ্য জানিয়েছে।
ইরান হিউম্যান রাইটস বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর দেশটিতে মৃত্যুদণ্ড ৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২১ সালের এ সময় ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ছিল ২২৬টি এবং ২০২০ সালে ছিল ২০৯টি।
সংস্থাটির প্রতিবেদন জানায়, ২০২২ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শুধু মাদকসংক্রান্ত অপরাধে একজন নারীসহ অন্তত ১৮০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
২০২১ সালে একই সময়ে ৮৩ জন এবং ২০২০ সালে এই ইস্যুতে ১৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র হলো বিশ্বের শেষ অবশিষ্ট সরকারগুলোর মধ্যে একটি, যা এখনও কিশোর অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ২০২২ সালের প্রথম ১০ মাসে কমপক্ষে দুজন কিশোর অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
২০২২ সালের প্রথম ১০ মাসে অন্তত ১২ জন নারীকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের দ্বারা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১১ জনকে হত্যার জন্য কিসাস (প্রতিশোধ-অনুরূপ) শাস্তি দেওয়া হয়েছিল এবং একজন বেলুচ নারীকে মাদকসংক্রান্ত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
বেড়েছে বেলুচ সংখ্যালঘু নির্যাতন
ইরানে বেলুচ সংখ্যালঘুদের অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অব্যাহত রয়েছে। ২০২১ সালে ইরানে হিউম্যান রাইটস বলেছে, দেশটিতে মোট কার্যকর হওয়া মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে ২১ শতাংশই ছিল বেলুচ। অথচ দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ থেকে ৬ শতাংশ বেলুচ।
২০২২ সালে অন্তত ১২১ জন বেলুচ নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা সব মৃত্যুদণ্ডের ৩৫ শতাংশ। ১২১ জনের মধ্যে একজন নারীসহ ৮২ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে মাদকসংক্রান্ত অভিযোগে।
দেশব্যাপী বিক্ষোভে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডে বেলুচ সংখ্যালঘুরাও ব্যাপকভাবে মারা গেছেন। দেশটিতে চলমান বিক্ষোভে মোট নিহতের সংখ্যার অর্ধেকই বেলুচ।
২০২২ সালে অন্তত ১২১ জন বেলুচ নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা সব মৃত্যুদণ্ডের ৩৫ শতাংশ।
ইরান হিউম্যান রাইটসের পরিচালক মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম বলেছেন, ‘৪৩ বছর ধরে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র সন্ত্রাস ও মৃত্যুদণ্ড সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে আছে। মৃত্যুদণ্ডের অমানবিক শাস্তির বিরোধিতা করা এবং এর বিলুপ্তির জন্য লড়াই করা স্বৈরাচারের চিরস্থায়ী অবসানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
অধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের টার্গেট করে দেওয়া সামঞ্জস্যহীন এসব মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বিশেষ করে দেশটির উত্তরপশ্চিমের কুর্দিদের, দক্ষিণপশ্চিমের আরবদের এবং দক্ষিণপূর্বের বেলুচদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে।
ইরানে সুন্নী মুসলিমদের নানা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অসংখ্য সুন্নী মুসলিমকে বিভিন্ন ইস্যুতে ফাঁসি দিয়েছে ইরান। শিয়ারা সুন্নী মুসলিমদের প্রতি এতটাই বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে যে দেশটিতে উসমান, উমর, আয়েশা নাম পর্যন্ত রাখতে পারেনা।
২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বিশ্বে ২০২১ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ২০ শতাংশ বেড়েছে, একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ।
একই সঙ্গে সংস্থাটি বলেছে, ইরান ২০১৭ সাল থেকে রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বেড়ে যাওয়ার শীর্ষে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। সেখানে ২০২১ সালে ৩১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, এর আগে ২০২০ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২৪৬ জনের, অর্থাৎ ২৮ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে মাদক সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত ১৩২ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় যা মোট মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ৪২ শতাংশ এবং ২০২০ সাল থেকে পাঁচগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বেশ কয়েকটি দেশ মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার রহিত করতে বা এর ব্যবহার সীমিত করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। গত বছরের জুলাই মাসে, সিয়েরা লিওনের পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিল পাসের জন্য ভোট দেয় মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার জন্য। একই ধরনের আইন কাজাখস্তানে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পাস হয়।
মালয়েশিয়াও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ওপরে স্থগিতাদেশ অব্যাহত রেখেছে এবং দেশটির সরকার বলছে যে তারা এ বছরের শেষ দিকে মৃত্যুদণ্ড ব্যবহারের বিষয়ে আইনী পরিবর্তন প্রস্তুত করবে। দেশটিতে বেশিরভাগ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় মাদক সংক্রান্ত মামলায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘লোকেরা মনে করে মৃত্যুদণ্ডে অবৈধ কাজ কমায়। মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও অপরাধ হয়, না থাকলেও হয়। এটি কমানোর জন্য সামাজিক সচেতনতা দরকার। কোনো অপরাধ হলে ‘ন্যায়বিচার’ চাই বলে দাবি ওঠে। ফাঁসি চাই বলা হয়। মৃত্যুদণ্ড হলেই ন্যায়বিচার হয়েছে বলা যায়? এটি ভয়াবহ অবস্থা, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৭
আপনার মতামত জানানঃ