জসিম মুহাম্মদ রুশনী
তাঁর নাম মুহাম্মদ বোরহানউদ্দিন ফিরোজ। ১৩৬৭ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ বুধবার সন্ধ্যায় উত্তর চট্টলার হাটহাজারী উপজেলার ছিপাতলী গ্রামে সম্ভ্রান্ত কৃষক আলী আহমদ ফকিরের কুটির আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মায়ের নাম মায়মুনা খাতুন।
চার কন্যা সন্তানের পর একমাত্র পুত্র সন্তান পেয়ে তাঁর পিতামাতা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলেন। পাশাপাশি বড়ো চার বোনের অকৃত্রিম আদর ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা “ফিরোজ খান” শৈশব থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। তাঁর বয়স যখন দশ বছর, তখনই শুরু হয় বাঙলাদেশের স্বাধীনতার মহাসংগ্রাম।
স্বাধীনতার যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তাঁর মেজোচাচা। সেই সুবাদে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে তাঁদের বাড়িটি। চাচার সতীর্থ যোদ্ধাদের সরাসরি দেখে তাঁর শিশুমনেই জন্ম নিয়েছিলো অকৃত্রিম দেশপ্রেম। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনায় তাঁর পিতার সাথে তিনিও লেগে থাকতেন। দীর্ঘ নয়মাসের এই স্বেচ্ছাসেবা তাঁর শিশুমনে রেখাপাত করে। তাই স্বাধীন দেশের একজন নওল কিশোর হিসেবে পড়ালেখার পাশাপাশি নানাবিধ সেবাকর্মে জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে।
তারুণ্যের দীপ্তিমান সময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে লেগে যান শিক্ষকতায়। একটি আলিয়া মাদ্রাসার সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে শুরু হলো কর্মজীবন। শিক্ষক হিসেবে কেবল পাঠদান ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন নিয়েই তাঁর পড়ে থাকার কথা, কিন্তু এর বাইরেও তিনি সমাজকর্মে মনোনিবেশ করেন। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৎবাঁধা মোল্লাতান্ত্রিকতা তাঁর পছন্দ হলো না বলে স্বল্প সময়েই সেই পাঠ চুকিয়ে নিলেন৷ ধর্ম সমাজ ও রাজনীতির বিষয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে পৈতৃক জমিজমা বিক্রি করে তা দিয়ে গড়ে তোলেন “পরম দিশারী সংস্থা” নামের একটি বহুমুখী সমাজ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অচিরেই সেটি ভিন্নমাত্রার চিন্তাশীল মানুষদের আখড়া হয়ে ওঠে। সেই সুবাদে সারাদেশেই সফর করবার সৌভাগ্য লাভ করেন।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ জনপদে সফর করে তিনি বুঝলেন যে প্রায় প্রতিটা জনপদেই মানুষ কোনও না কোনও বিচ্ছিন্ন কুসংস্কারে আপতিত আছে। বিশেষ করে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক অজ্ঞতাকেই তিনি মানুষের পশ্চাৎপদ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন। “অজ্ঞতার তিরোধানে বিভ্রান্তির অবসান” শীর্ষক একটি জনসচেতনতামূলক লেখালেখি কার্যক্রম চালু করলেন। সে কার্যক্রমে জড়িত হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষিত যুবক ও ছাত্রসমাজ। সেই কর্মসূচি থেকে ১৯৯৮ সালে বেরিয়ে আসে “সর্বময় ডাক” নামের একটি বুকলেট।
সর্বময় ডাক শিরোনামের বুকলেট জনসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। চিন্তাশীল মানুষদের সমাগম বেড়ে যায় তাঁর সমাজ গবেষণা কেন্দ্রে। পরস্পর বিপরীতমুখী ও বিপরীতধর্মী ভাবধারার গবেষকদেরকে এক টেবিলে বসানোর বিরল কৃতিত্ব স্থাপন করলেন তিনি। আশ্চর্যের হলেও সত্য যে একই টেবিলে ইসলামিক ভাবাদর্শ ও মার্কসবাদী চিন্তাধারার গবেষণাকর্ম একটানা চলেছে কয়েক বছর। ইসলামিস্ট ও কমিউনিস্ট চিন্তকদের এই অপূর্ব সমন্বয় দেখে মানুষ বিস্মিত না হয়ে পারেনি।
মাদ্রাসার পড়ুয়া হওয়ার পরেও তিনি মোল্লাতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন ছাত্রজীবন থেকেই। সে কারণে কতিপয় ধর্মজীবী তাঁকে মুরতাদ ঘোষণা করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। তারপরও তিনি তাঁর জনহিতকর কাজ থেকে সরে আসেননি। শিক্ষা ও গবেষণাকর্মের পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষদের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বোরহানিয়া প্রাইভেট লিমিটেড। সুবিধাবঞ্চিত স্বল্পশিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থান করেন সেখানে। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রায় কুড়িজন যুবককে কর্মদক্ষতার প্রশিক্ষণ দিয়ে জনশক্তি রপ্তানির কাজে ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ্য – সেই কুড়িটিরও অধিক পরিবার নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে আরও শতশত পরিবারের অবস্থা পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে এবং রেখে যাচ্ছে।
শিক্ষা ও মানবিক উন্নয়নের রচনা ও গবেষণাকর্ম, দক্ষ যুবগোষ্ঠী তৈরি করার পাশাপাশি মানুষের ধর্মীয় চেতনার উৎকর্ষের উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী বিনা পারিশ্রমিকে ধর্মীয় সভা সেমিনারেও সরব ছিলেন।
এতো জনহিতকর কাজ করার পরও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ প্রচার বিমুখ। ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে অনেক গণমাধ্যমকর্মী থাকার পরও তিনি কাউকেই তাঁর প্রচার করতে দেননি। সবার উদ্দেশ্যে বলতেন – “আমাকে নয়, প্রচার চিরোজ্জ্বল সত্যকে। ধর্মের মর্মবাণী ধারণ করে তা জনসমাজে ছড়িয়ে দাও যার যার অবস্থান থেকে। তাতেই আমি তুষ্ট হবো।”
নিজ জীবনচর্চায় পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতেন বিশ্বনবী মুহম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। কুরআন ও সুন্নাহ্’র গবেষণা অভিনব নির্যাস বের ছড়িয়ে দিতেন জনসমাজে, তারপরও নিজেকে দ্বীনের দাঈ বলে দাবি করতেন। এমনকি একজন সর্বোচ্চ সনদধারী আলেম হয়েও নিজের নামের সাথে কখনও “মাওলানা” কিংবা “আল্লামা” টাইটেল লাগাতেন না। কয়েক হাজার অমুসলিম ভক্তও ছিলো তাঁর, তাদেরকে কখনও জোর করে আপন ধর্মচিন্তা চাপিয়ে দেননি। এর জবাবে বলতেন – “আমার দায়িত্ব আমার আচরিত ধর্মের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা, কাউকে জোর করে মুসলিম বানানো নয়।”
সর্বশেষ “বাংলাদেশ আস্ সুন্নাহ্” কমিটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে গত ২২ বৈশাখ (৫ মে) বুধবার দিবাগত রাত ১ ঘটিকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অন্তিম যাত্রায়ও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একটি মানবিক মহাসমাবেশ হয়ে গেলো নিজ জন্মগ্রামে ছিপাতলীতে।
জসিম মুহাম্মদ রুশনী // কবি, কলামিস্ট ও গবেষক
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, স্টেটওয়াচ কর্তৃপক্ষের নয়।
আপনার মতামত জানানঃ