জসিম মুহাম্মদ রুশনী
প্রায় ঊনিশ বছর পর বাঙলাদেশের ফুটবল অন্দরে একটি শিরোপা ঢুকেছে। শিরোপাটা এনেছে দেশের অবহেলিত প্রমীলা ফুটবলাররা। সঙ্গতঃ কারণেই আনন্দে ভাসছে বাঙলাদেশ। শত অপ্রাপ্তি আর হতাশার মাঝেও জাতীয় জীবনে নির্মল উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রমীলা ফুটবলারদের এই অর্জন হয়তো আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে আহামরি কিছু নয়; আবার একদম ফেলনা বিষয়ও নয়। যেখানে বছরের পর বছর বাফুফে নামের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান অঢেল টাকা উড়িয়েও প্রাপ্তি যোগ করতে পারেনি সামান্যও, সেখানে সামান্য ইনভেস্টের আউটপুট হিসেবে প্রমীলারা অপরাজিত চ্যাম্পিয়নশিপ ঘরে এনে দিয়েছে মরুভূমিতে আকস্মিক ঝর্ণাধারার মতো। আম পাবলিক নির্মল আনন্দে ভাসছে।
আম পাবলিক আনন্দে ভাসলেও বিশেষ তিনটি শ্রেণির মনস্তাত্ত্বিক বৈপরীত্য দৃশ্যমান হয়েছে দেশে। এর একটি পক্ষ রাজনৈতিক দাসত্ববাদী সমাজ, অন্য দু’দল ধর্মবাদী ও ধর্মবিদ্বেষী উন্নাসিকতার। রাজনৈতিক দাসত্ববাদীরা তাদের দাসমনোবৃত্তির মগ্ন প্রকাশ ঘটাচ্ছে এ -ই বলে যে – “প্রধানমন্ত্রীর উদারতার কারণে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাঙলার মেয়েরা।” আর ধর্মকেন্দ্রিক বিকলমস্তিষ্কগুলো উগলে দিচ্ছে তাদের বস্তাপঁচা বাতিল চিন্তাগুলো।
জাতি হিসেবে ঠিক যেখানে গিয়ে আমাদের পৌঁছুনোর কথা তার পথেই এখনও নামতে পারিনি আমরা। পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ আমাদের এতোটাই অথর্ব করে ছেড়েছে যে আমরা এখনও সভ্যদের তালিকায় ওঠার যোগ্যতাটাও হাসিল করতে পারিনি।
ধর্মোন্মাদ গোষ্ঠীর মন্তব্য হলো – “একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশের মেয়েরা অর্ধোলঙ্গ পোশাক পরে ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তা নিয়ে এতো মাতামাতির কী আছে?” আর ধর্মবিদ্বেষী গোষ্ঠী সোৎসাহে উচ্চকণ্ঠ হয়ে বলছে – “আমাদের মেয়েদের এই অর্জন ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে।”
রাজনীতি ও ধর্মাশ্রয়ী তিনটি ধারার মূল্যায়ন পেয়ে আমরা কী বুঝতে পারলাম? বুঝলাম – জাতি হিসেবে ঠিক যেখানে গিয়ে আমাদের পৌঁছুনোর কথা তার পথেই এখনও নামতে পারিনি আমরা। পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ আমাদের এতোটাই অথর্ব করে ছেড়েছে যে আমরা এখনও সভ্যদের তালিকায় ওঠার যোগ্যতাটাও হাসিল করতে পারিনি।
ধর্মোন্মাদ গোষ্ঠী মন্তব্য পর্যন্তই সীমিত কিন্তু ধর্মবিদ্বেষী গোষ্ঠী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের উপর একেবারে দাঁড়িয়ে গেছে নিজেদের বিদ্বেষ উগলানোর জন্য। ইতিমধ্যেই নেট দুনিয়ায় বেশ কিছু কার্টুন ছড়িয়ে দিয়েছে। সে কার্টুনগুলোকে কেন্দ্র করে ধর্মোন্মাদ গোষ্ঠী “অনুভূতিতে আঘাত হানার” অভিযোগ এনে সহিংসতা শুরু করলেও অবাক হবো না, কারণ এরকম ঠুনকো মামুলি ইস্যু নিয়ে সহিংসতা ছড়ানোর ইতিহাস নিকটাতীতেই আছে।
বাঙালি তার কলহপ্রিয়তার নজির স্থাপন করছে ক্রমশঃ। দল মত ধর্ম গোত্রের বাতাবরণে কতোটা নীচতার পরিচয় দেয়া যায় সেই প্রতিযোগিতাই যেন আরাধ্য এখানে। পরস্পর বৈরী দু’টি শ্রেণির দেখা মিলে যাচ্ছে প্রতিটি ইভেন্টেই। সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো গৌরবময় কীর্তিকেও যারা নিজেদের হীনমন্যতার আধার বানায় তাদেরকে পৃথিবী কী বলে মূল্যায়ন করবে?
পুনশ্চঃ – যারা যা -ই বলুক, প্রমীলা খেলোয়াড়দের এগিয়ে নেয়ার জন্য রাষ্ট্রকেই ভূমিকা রাখতে হবে। নারী পুরুষের বৈষম্য থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পুরুষ ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যতোটা উদার হয়ে পুরস্কৃত করে প্রমীলা ফুটবলারদের সেভাবে করলো না দেখেও আমরা আশাবাদী হতে চাই। জাতির মনস্তাত্ত্বিক উন্নাসিকতাকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র তার যথার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক – আমরা এমনটাই চাই।
আপনার মতামত জানানঃ