২৪ মে ১৯৬৪। পেরুর রাজধানী। লিমার ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। টোকিও অলিম্পিকের ফুটবল কোয়ালিফায়িং রাউন্ডের খেলা। স্বাগতিক দেশ পেরু বনাম আর্জেন্টিনা। মাঠে দর্শকসংখ্যা ৫৩ হাজার। কোনো সন্দেহ নেই আর্জেন্টিনা শক্তিশালী দল, তখনকার পেরুও শ্রেষ্ঠ দলগুলোর একটি। আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে এগিয়ে।
আর্জেন্টিনা পেরুতে এসে গোল করে এগিয়ে থাকবে-এতেই যথেষ্ট অস্বস্তি ভোগ করছিল পেরুর মাঠভর্তি দর্শক। পেরু-আর্জেন্টিনার খেলার দিন স্টেডিয়ামে ঢোকার টিকিটের দাম ৩০ সোল, প্রায় এক ডলার, শ্রমিকদের রোজকার মজুরির প্রায় দ্বিগুণ। তবুও তারা এসেছে: বাড়তি কাজ করে ক্ষতি পোষানো যাবে-কিন্তু এ খেলা তো আর পাওয়া যাবে না। (বর্তমান বিনিময় হার ১ সোল সমান বাংলাদেশের ২৭ টাকা)। এটাই ল্যাতিন আমেরিকার বৈশিষ্ট্য: ফুটবলের জন্য ছুটি নেবে, ধার করে টিকিট কিনবে এবং এমনকি দেশের প্রেসিডেন্টও সব জরুরি কাজ ও বৈঠক স্থগিত করে খেলার ধারাবিবরণী শুনবেন।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হলো সমানে সমান এগোচ্ছে। পেরুর প্রাথমিক লক্ষ্য সমতা সৃষ্টি আর আর্জেন্টিনার লক্ষ্য আর একটি গোল দিয়ে দূরত্ব বৃদ্ধি যেন তাদেরও পেরু-আতঙ্ক না থাকে। দ্বিতীয়ার্ধের ৩৯ মিনিট একই অবস্থায় কেটে গেল। ঠিক ছয় মিনিট আগে পেরুর ফরোয়ার্ড কিলো লোবান আর্জেন্টিনার প্রতিরক্ষাদেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকে একেবারে গোলপোস্টের সামনে একটি সফল শট দিয়ে বল জালে ঢুকিয়ে দিলেন। আনন্দে চিৎকার করে উঠল স্টেডিয়াম। তাহলে ড্র। অন্তত এ মুহূর্তে পরাজয়ের গ্লানি তো নেই। ঠিক তখনই রেফারির বাঁশি বাজল। স্টেডিয়াম হতচকিত।
উরুগুয়ের রেফারি অ্যাঞ্জেল এদুয়ার্দো প্যাজোস গোল নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন-ফাউল হয়েছে। ‘থ’ হয়ে থাকা অবস্থাটা কাটতে সময় লাগল না। দর্শকেরা হাতের কাছে যা পেল-জুতো, বোতল, দেয়ালভাঙা ইট, সিট কুশন-অবিরাম মাঠে নিক্ষেপ করতে শুরু করল। দর্শক ও খেলার মাঠের বিভাজন ৯ ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বিশালাকার এক কালো মানুষ মাতিয়াস বোজাস মাঠে নামলেন। তিনি সবার কাছে বোম্বা নামে পরিচিত। পুলিশের খাতায় তার রেকর্ড ভালো নয়। তিনি আগে একবার রেফারিকে পিটিয়েছেন। তিনি যখন মাঠের ভেতর এগোচ্ছিলেন, দর্শকদের মধ্যে শোর ওঠে- ‘আহি ভা বোম্বা’ (ওই তো বোম্বা যায়)।
রেফারি পর্যন্ত পৌঁছার আগেই পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। পুলিশকে তিনি বললেন, ‘আমি পেরুর হারা সহ্য করতে পারি না-আমার কী হয়, আমি জানি না, মেজাজ ও শরীর গরম হয়ে ওঠে।’
এটা ঠিক বোম্বাও রেফারিকে পেটাতে চেয়েছিলেন। পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। দ্রুত আরও একজন দর্শক এদিলবার্তো কুয়েন্সা রেফারির দিকে ছুটলে পুলিশ তাকে আটকে স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের সামনে নির্মমভাবে পেটাল। এতে দর্শকের ক্রোধ আরও বহুগুণ বেড়ে গেল।
ওদিকে আতঙ্কিত রেফারি ঘড়ি ধরে সময় গুনে আর্জেন্টিনাকে বিজয়ী ঘোষণা করে দ্রুত পালিয়ে গেল। হোসে সালা নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বললেন, পুলিশ যেভাবে এদিলবার্তো কুয়েন্সকে লাথি মারছিল এবং পেটাচ্ছিল মনে হয়েছে, তারা তাদের শত্রুর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ততক্ষণে টিয়ার গ্যাস ছোড়া শুরু হয়ে গেছে। মাঠে ঢুকেছে অশ্বারোহী পুলিশ। দর্শকদের নিক্ষেপ করা অব্যাহত রয়েছে, হাতের কাছে যা পাচ্ছে, তাই মিসাইল বানিয়ে ছুড়ছে। হোসে সালা জানাচ্ছেন, তারা পাঁচজন দ্রুত গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। গেট বন্ধ।
রেফারি পালালেন ইস্পাতের দরজার ভেতরে ড্রেসিংরুমে। জনতা আতঙ্কিত এবং গ্যাসের ধোঁয়ার প্রতিক্রিয়ায় চারদিকে অন্ধকার। পাহাড় গুঁড়িয়ে দেওয়া ভয়ংকর শব্দ হচ্ছে। টানেলের মতো একটি গেট দিয়ে সবাই বেরোতে চেষ্টা করছে, পারছে না, পদপিষ্ট হচ্ছে, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় লুটিয়ে পড়ছে। কিছু স্থিতিশীল মানুষ অবশ্য চিৎকার করে বলছেন, তোমরা শান্ত হও, না হলে সবাই মরবে।
লিওনার্দো ক্যাভালাস নামের একজন জেলে মাছ ধরা রেখে ফুটবলের আনন্দোৎসবে স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে এসেছিলেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে তার বিলাপ শোনা যাচ্ছে- আমার স্ত্রী আর পাঁচ সন্তানের একজনও বেঁচে নেই।
দর্শকেরা বেরোতে পারছিলেন না কেন? এর সম্ভাব্য জবাব হচ্ছে, তালা খোলার দায়িত্বে নিয়োজিত স্টেডিয়ামের কর্মচারীরাও সে সময় শেষ মুহূর্তের উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থাটি দেখার জন্য গ্যালারির কাছাকাছি ছিলেন। তারা ভিড় ঠেলে এসে পৌঁছাতে পারছেন না।
প্রাণে বাঁচা একজন বললেন, স্টেডিয়ামের ভেতরে থেকে তিনি শুনেছেন, ২ জনের মৃত্যু হয়েছে-পদপিষ্ট হয়ে। কিছুক্ষণ পর শুনলেন ২ জন নয়, ১০ জন, তারপর ২০ জন, তারপর ৩০ জন। ৫০, ১০০, ১৫০, ২০০ …. এভাবে সংখ্যা বাড়তেই থাকে। শুধু কি টিয়ার গ্যাস? পুলিশ গুলিও করেছে। দুদিন পরের সরকারি হিসাব: মৃত্যুর সংখ্যা ৩২৮। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, সংখ্যা আরও বেশি-যারা গুলিতে নিহত হয়েছে, পুলিশ মর্গ ও হাসপাতাল থেকে তাদের মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। একজন তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, তাড়াহুড়ো করে অনেক মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছে।
কাস্তানেদা নামের একজন বুড়ো জানালেন, মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া তার দুই ছেলে ভিন্ন একটি প্রদেশ থেকে লিমাতে এসেছিল আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে পেরুর খেলা দেখতে। তার দুই ছেলে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। তিনি তাদের লাশও দেখেননি। স্টেডিয়ামে নিহতদের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও তাদের নাম নেই।
গুলিতে কেউ মরেছে কিনা, তা যাচাই করতে যে তদন্ত কমিটি হয়-সে কমিটির প্রধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মৃত যাদের দেখেছেন, তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ কাউকে তার চোখে পড়েনি। তবে স্টেডিয়ামের ভেতর থেকে কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোড়ার আদেশ দিয়েছিলেন পুলিশ কমান্ডার হর্হে আজামবুজা। বাড়াবাড়ির অভিযোগে তাকে ৩০ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৩২৮ জনের সকলের সুরতহাল ময়নাতদন্তে হাজির না থাকার অভিযোগে একজন বিচারককে জরিমানা করা হয়।
মৃত্যুর সংখ্যা সত্যিই ৩২৮, নাকি আরও বেশি-এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, যদিও এটা সঠিক বিশ্বকাপে বা কেনো কোনো ধরনের ফুটবল বা অন্য কোনো ক্রীড়ানুষ্ঠানে এত লোকের মৃত্যু হয়নি। তিন ঘণ্টার যজ্ঞের মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলেই সবার ধারণা। আহত অন্তত এক হাজার। স্টেডিয়ামের বাইরে সেদিন কায়েম হয় এক লুটের রাজত্ব। ১০০ গাড়ি চুরি হয়ে যায়। এ ঘটনার কথা শুনে লিমা কারাগারেও একটি সহিংস আন্দোলন ঘটে যায়। ২১ জন দাগি আসামি পালিয়ে যায়। পেরু সরকার ৭ দিনের শোক ঘোষণা করে।
এসডব্লিউএসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ