দেশের প্রধান নদ-নদীগুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে কয়েক মাস রাজধানীর চারপাশের বিভিন্ন নদীর পানি এতটাই দূষিত হয়ে পড়ে যে, তখন এ পানিতে মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। এই দূষিত পানির মাছ মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহারও ঝুঁকিপূর্ণ। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদীতে ফেলা হয়। দেশের ২৯টি প্রধান নদ–নদীর দূষণমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এগুলোর পানির দূষণ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছাচ্ছে। মাছের উৎস এমন নদীও মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এসব নদীর পানিতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রার ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে নদী থেকে সকল দখলদার, মাছপ্রকল্প, সুইসগেট, বাঁধ, স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেতু অপসারণ করতে হবে অবিলম্বে। আমাদের অধিকাংশ নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। ১৯৭১ সালের তুলনায় আমাদের শীতকালের মোট নদীপথ ৮৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
শীতলক্ষ্যা থেকে ডাঙায় উঠে আসছে মাছ
শীতলক্ষ্যা নদীর নদীর গভীর পানিতে যেসব মাছের বিচরণ করার কথা, সেগুলো এখন ভেসে উঠছে পানির ওপরে। বরমী ও কাপাসিয়ার সিংহশ্রী ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে নদীর মাছ পানির ওপর ভেসে উঠছে। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আর জলজ প্রাণী ভেসে ওঠার ঘটনায় নদীর দুই পাড়ে উৎসবের আবহ তৈরি হয়েছে। বিপুল উৎসাহ নিয়ে মাছ ধরতে নেমে গেছে স্থানীয়রা। তবে বিষয়টি যে স্বাভাবিক নয়, তা বুঝতে পারছে নদীতীরের সাধারণ মানুষ। দুই পাড়ের মানুষ বংশানুক্রমিকভাবে এ নদীর মাছের ওপর ভরসা করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তারা জানেন, এ কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
কয়েক বছর ধরে নদীতে শিল্পবর্জ্য মিশছে। ফলে আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। প্রায়ই এভাবে মাছ পানির ওপরে উঠে আসার ঘটনা ঘটে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মাছশূন্য হয়ে পড়বে শীতলক্ষ্যা।।
মাছ ধরতে আসা কয়েকজন জানান, মাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল, এগুলো যেন আর নদীতে থাকতে পারছে না। তাই লাফিয়ে ডাঙায় উঠে আসছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চিংড়ি থেকে শুরু করে টেংরা, বাইম, রিঠাসহ নানা ধরনের মাছ।
নরসিংদী, গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যার দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও বানার নদী থেকে উৎপত্তি গাজীপুরের শীতলক্ষ্যার।
কিন্তু কয়েক বছর ধরে পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার শিল্প-কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য ক্ষিরু ও মাটিকাটা নদীর মাধ্যমে মিশছে শীতলক্ষ্যায়। ফলে স্বচ্ছ জলের নদী হিসেবে পরিচিত শীতলক্ষ্যা এখন কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত পানির নদীতে পরিণত হয়েছে। দূষণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে মাছের উৎপাদন। সেই সঙ্গে কমেছে মাছ ধরে জীবিকা আহরণ করা মানুষের সংখ্যাও।
শিল্প-কারখানার দূষণে বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বলে মন্তব্য করেছেন গাজীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মাছের দুর্দশা দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে শীতলক্ষ্যার নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরকে অনুরোধ করব তারা যেন নদীর পানিকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়। এতে নদীর পানিও ভালো থাকবে, মাছসহ অন্যান্য প্রাণীও অবাধে বসবাস করতে পারবে।
পানির ওপর এভাবে মাছ ভেসে ওঠার কারণ হিসাবে বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাজী রেজাউল করিম বলেন, নদীতে যখন দূষণের মাত্রা বেড়ে যায় তখন মাছ ভেসে ওঠে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে মাছ বেঁচে থাকে। কিন্তু পানিতে যখন বর্জ্য ফেলা হয় তখন ওই বর্জ্য পচতে অক্সিজেন ব্যয় হয়। এতে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। ফলে মাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না। সে কারণে অক্সিজেন নেয়ার জন্য মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী পানির ওপরে ভেসে ওঠে।
বানার নদে মরে ভেসে উঠছে দেশি মাছ
এদিকে গাজীপুরের শ্রীপুরের বানার নদ ও সুতিয়া নদীতে রোববার রাত থেকে দেশি মাছ মরে ভেসে উঠছে। সেখানেও পানির রং ঘন কালো। মাছ কুড়ানো কয়েকজনের গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুতিয়া ও খীরু নদী হয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকার শিল্পবর্জ্যমিশ্রিত পানি এসে বানার নদে মিশেছে। গতকাল রাত থেকেই প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসা শুরু করে। এর আগে দূষিত পানি এলেও এতটা তীব্র গন্ধ ছিল না। বড় বড় মাছ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে নদীর পাড়ে এসে ভেসে থাকতেও দেখা গেছে।
শ্রীপুরে বরমী এলাকার পাইটাল বাড়ি গ্রামের মাছ শিকারি কিরণ মিয়া বলেন, ভোররাত থেকেই শত শত মানুষ নদের পানিতে ভেসে ওঠা ও দুর্বল হয়ে চলতে থাকা মাছ ধরছেন। বানার নদে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত পানি এসে মিশেছে। এর ফলে মাছ অক্সিজেন পায় না। মাছগুলো মারা যায়। চার থেকে পাঁচ বছর ধরে নদীর পানি খুব বেশি দূষিত হয়। মাছের পোনা মারা যায়।
নান্দিয়া সাঙ্গন গ্রামের বাসিন্দা মো. মোবারক বলেন, আমরা বেশ কয়েকজন মিলে সাত থেকে আট কেজি চিংড়ি, বাইন, বোয়াল, রিঠা মাছ ধরেছি। চার–পাঁচ বছর ধরেই নদীতে মাঝে মাঝে একসঙ্গে প্রচুর মাছ মরে ভেসে ওঠে। পানির রং একদম কালো হয়ে গেছে। দুর্গন্ধে আশপাশে যাওয়া যায় না।
বরমী এলাকার বাসিন্দা আলামিন বলেন, দেশি মাছের বড় উৎস এই নদ-নদীগুলো। অথচ শিল্পকারখানার বর্জ্যের কারণে এগুলো মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। গতকাল গভীর রাত থেকে নদ-নদীগুলোর মাছ দুর্বল হয়ে মরে যাচ্ছে।
কীর্তনখোলা নদীর পানিতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ গুণ লবণাক্ততা
বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানিতে অস্বাভাবিক মাত্রায় লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করে এ নদীর পানির লবণাক্ততা স্বাভাবিকের চেয়ে চার গুণের বেড়ে যাওয়ার কারণ জানা না গেলেও, সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন উজান থেকে আসা পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বা কম বৃষ্টিপাতের কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে। এতে স্বাদু পানির প্রাণী হুমকির মুখে পড়তে পারে আশঙ্কা করছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
১৬০ কিমি দীর্ঘ কীর্তনখোলা নদী বরিশালের শায়েস্তাবাদ থেকে শুরু হয়ে ঝালকাঠি জেলার গাবখানে গিয়ে পড়েছে। গত এক মাস ধরে লবণাক্ততা বেড়েছে। আগে এই পানিতে তারা হাত-মুখ ধুলেও লবণাক্ততার কারণে এখন পানি মুখে তুলতে পারছেন না।
নদীর পূর্ব তীরের চরকাউয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ছবি জানান, গত এক মাস ধরে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনি এলাকাবাসীর মুখে শুনেছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় অফিসের সহকারী বায়োকেমিস্ট মুনতাসির রহমান জানান, নদীর চরকাউয়া, লঞ্চঘাট ও দপদপিয়া পয়েন্টে গত ৭ মার্চ পানি পরীক্ষা করে ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি (ইসি) পাওয়া গেছে ১৩৬০ মাইক্রো সিমেন্স পার সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিক সময়ে ৩০০ থেকে ৪০০ মাইক্রো সিমেন্স পার সেন্টিমিটার পাওয়া যেত। সাধারণত ইসি ১২০০ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য ধরা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কামরুজ্জামান সরকার জানান, হঠাৎ পানিতে লবণাক্ততার বৃদ্ধি চিন্তার কারণ। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়া বা উজান থেকে আসা পানিতে লবণাক্ততা এর কারণ হতে পারে। এর ফলে স্বাদু পানির প্রাণী হুমকির মুখে পড়তে পারে। স্বাদু পানির মাছের ক্ষতি হলে জীবন জীবিকায় এর প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, ‘এতে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমরা এখনই এর সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারছি না। এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর বলেশ্বর নদীতে হঠাৎ লবণাক্ততা বেড়ে গিয়েছিল। পরে দেখা যায়, শাখা নদী দিয়ে উজানের পানি আসায় বাধা তৈরি হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ওই বাধা অপসারণ করার পর পানির লবণাক্ততা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
স্বাধীনতার পর বিআইডাব্লিউটিএ’র তরফে যে জরিপ হয়েছিল তাতে জানা গিয়েছিল বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য ২৪০০০ কিলোমিটার। কিন্তু এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০০০ কিলোমিটার। এ থেকেই বুঝতে পারেন নদীগুলোর অবস্থা আসলে কেমন। অর্থাৎ প্রায় চার দশকে ১৬০০০ কিলোমিটার নদীপথ শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু যেখানে নদনদীর সংখ্যা নিয়েই কেউ একমত হতে পারছে না, সেখানে গত ৫০ কিংবা ১০০ বছরে বাংলাদেশে ক’টি নদীর মৃত্যু ঘটেছে? কিন্তু এ সম্পর্কে পাকা খবর কারো কাছেই নেই। মানুষ তার লোভ কিংবা মুনাফার টানে নদীর শুধু গতিপথই বদলে দিচ্ছে না, আঘাত করছে নদীগুলোর প্রাণবৈচিত্রেও। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু, শীতলক্ষ্যার মতো নদীগুলোর দু’ধারে যে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, তার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে পড়ছে এসব নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় মরে যাচ্ছে নদীর প্রাণ। পর্যাপ্ত পদক্ষেপের অভাবে যা বড় ধরনের বিপর্যের কারণ হয়ে উঠবে।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৪২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ