বাংলাদেশে গত ২৭ই জানুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধনের পর ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে এ কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকার তারিখ পড়েছে রোজার মাসেই। এছাড়া নতুন নিবন্ধনকারীদের অনেকের তারিখও রোজার মাসে পড়েছে। আগামী ১৪ই এপ্রিল থেকে রমজান মাস শুরু হওয়ার কথা।
দেশটিতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই রোজা পালন করেন অর্থাৎ তারা দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থাকেন। ফলে এর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে যে, রোজা রেখে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সমস্যা হতে পারে কিনা।
রমজানের সময় দিনের বেলায় মুসলমানরা খাবার ও পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। ইসলামিক শিক্ষায় বলা হয়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শরীরের ভেতরে কিছু প্রবেশ করানো থেকে মুসলমানদের বিরত থাকা উচিত।
বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি মারফত জানা যায়, ইসলামী শিক্ষাবিদ এবং যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বলছে, রমজানের সময়ে রোজা থাকলেও মুসলমানদের টিকা নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত হবে না।
যুক্তরাজ্যের মসজিদ এবং ইমামদের জাতীয় উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান কারী আসিম বলছেন, টিকা যেহেতু পেশীতে দেয়া হয়, রক্তের শিরায় যায় না, এটি পুষ্টিকর কিছু নয়, সুতরাং টিকা নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
”ইসলামী চিন্তাবিদদের বেশিরভাগের দৃষ্টিভঙ্গি হলো যে, রমজানের সময় টিকা নেয়া হলে সেটা রোজা ভঙ্গ হয় না,
মুসলমান কম্যুনিটির জন্য তার বার্তা হলো: ”আপনি যদি টিকা নেয়ার উপযুক্ত হন এবং টিকা নেয়ার আমন্ত্রণ পান, তাহলে আপনার নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে হবে, আপনি কি টিকা নেবেন যা এর মধ্যেই কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে, নাকি কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেবেন, যা আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে এবং যার ফলে হয়তো পুরো রমজানই হারাতে পারে, হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকারও হতে পারে।”
পূর্ব লন্ডনের সার্জারি প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ড. ফারজানা হুসেইন বলছেন, দিনের বেলায় টিকা নেয়া থেকে বিরত থাকার আসলে কোন প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ”আমরা জানি, রমজানের সময় কোভিডের টিকা নেয়া নিয়ে অনেক মুসলমানের মধ্যে সংশয় রয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই সময় ইনজেকশন নিলে তাদের রোজা ভেঙ্গে যাবে,” তিনি বলছেন, ”কিন্তু এটা একেবারেই তা নয়, কারণ এর মাধ্যমে আসলে শরীরে কোন খাবার প্রবেশ করছে না।”
তিনি বলেন, ”কোরানে বলা আছে, তোমার জীবন রক্ষা করা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: ‘একটা জীবন বাঁচানো মানে হলো পুরো মানব জগতকে বাঁচানো।’ সুতরাং একজন মুসলমান হিসাবে টিকা নেয়া একটা দায়িত্ব।”
বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশনও গত ১৪ই মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভা কক্ষে দেশের জ্যেষ্ঠ আলেমদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ের পর জানিয়েছে, রোজা রেখে করোনাভাইরাসের টিকা নিতে কোন সমস্যা নেই।
এতে বলা হয়, সভায় রোজার মাসে কভিড-১৯ এর টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং দেশের জনগণের সুরক্ষার জন্য টিকা নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আলোচনায় উপস্থিত আলেম সমাজ সর্বসম্মতভাবে একমত পোষণ করেন যে, যেহেতু করোনাভাইরাসের টিকা মাংসপেশিতে গ্রহণ করা হয় এবং তা সরাসরি খাদ্যনালি বা পাকস্থলীতে প্রবেশ করে না, সেহেতু রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি দিনের বেলায় শরীরে টিকা গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলেমরাও একইরূপ মত পোষণ করেছেন। কাজেই রোজা রেখে করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করা যাবে। বাংলাদেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান শুরু হয়েছে। যারা ইতিমধ্যে টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে দুই মাস পর। ফলে ফেব্রুয়ারিতে যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজের তারিখ পড়বে এপ্রিলে রোজার মধ্যে।
জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’ গ্রন্থের প্রণেতারা এবং মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দিন ‘প্রণীত আহকামে জিন্দেগী’ বইটিতেও টিকা বা ইনজেকশনের মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে বিকল্প খাদ্য হিসেবে যা গ্রহণ করা হয় তার মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ হবে।
বহু আলিম ও মুফতির মত অনুযায়ী, যদি টিকা বা ইনজেকশন মাংসপেশীতে নেয়া হয় এবং চিকিৎসা বা রোগ-বালাইয়ের জন্য নেয়া হয়, তাহলে এর মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ হবে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই ইনজেকশন খাদ্য নয়, এটা কোনো পানীয় নয়, এটা সরাসরি পাকস্থলিতে যায় না- যা রোজা ভঙ্গের কারণের মধ্যে একটি।
তবে রোজা অবস্থায় ইনজেকশন বা টিকা দেয়ার সময় সতর্ক থাকা উচিত। কারণ অনেক সময় টিকা বা ইনজেকশন দেওয়ার সময় রক্ত প্রবাহের চাপ থাকার কারণে, রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় রক্ত বেরিয়ে আসা, রোজা ভঙ্গ হওয়ার কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আবার টিকার প্রভাবে অনেক সময় তাৎক্ষণিক বমি হয়। হয়তো টিকা দেয়া হয়েছে সকাল ৭টায়, দুই-তিন ঘণ্টা পরে এর প্রভাবে বমি হয়েছে, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
বিশ্ববাসী এখন করোনাকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য ভ্যাকসিন বা টিকা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে টিকা দেওয়ার সময়সূচি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। এদিক থেকে সতর্কতার সঙ্গে করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা নিতে কোনো রোজাদারেরই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যেহেতু রোজা অবস্থায় সতর্কতার সঙ্গে টিকা নিতে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে সমস্যা নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ