ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির লক্ষ্যে প্রথমবারের মত এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে দিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন(বিইআরসি)। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হিসেবে বেসরকারি পর্যায়ে এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৯৭৫ টাকা (মুসকসহ) নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আর সরকারি পর্যায়ে এলপিজির সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৫৯১ টাকা (মুসকসহ) নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া কমিশন প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম প্রতি লিটার ৪৭ দশমিক ৯২ টাকা নির্ধারণ করেছে।
সোমবার বিইআরসি এক সংবাদ সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই দাম আজ থেকে কার্যকর হবে বলেও জানিয়েছে তারা।
দেশে গ্যাস সংকট বাড়তে থাকায় এলপিজির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এর দাম নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণে রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা নেই। অথচ আইন অনুযায়ী দেশে এলপিজির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার শুধু বিইআরসির। এমন বাস্তবতায় এলপিজির দাম বিইআরসির মাধ্যমে নির্ধারণের জন্য গত বছর আদালতে রিট আবেদন করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। আদালতের রায় মেনে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ বিষয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানি শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে মূল্যহার ঘোষণার নিয়ম রয়েছে। আগামী বুধবার এ সময়সীমার শেষ দিন। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার দুই দিন আগেই সোমবার ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির নির্ধারিত মূল্যহার ঘোষণা করলো বিইআরসি।
সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, গণশুনানি শেষে সবকিছু বিচার-বিবেচনা ও দাখিল করা তথ্য যাচাই-বাছাই করে একাধিক সভার মাধ্যমে কমিশন দাম চূড়ান্ত করেছে। এই দাম আজ থেকে কার্যকর হবে। পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত তা বহাল থাকবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, দাম সারাদেশে অভিন্ন থাকবে। ভোক্তারা বাড়তি দাম দেবেন না। কমিশনের আদেশ বাস্তবায়ন করতে লাইসেন্সধারীরা বাধ্য। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, গত মার্চে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি কোম্পানি সৌদি আরামকোর প্রোপেনের মূল্য প্রতি টন ৬২৫ ডলার ও বিউটেনের মূল্য প্রতিটন ৫৯৫ ডলার বিবেচনায় নিয়ে এবং এলপিজিতে ৩৫ অনুপাত ৬৫ হারে প্রোপেন ও বিউটেনের মিশ্রন বিবেচনায় নিয়ে এই দাম নির্ধারন করা হয়েছে।
প্রতি মাসে সৌদি আরামকো তাদের মূল্য সংশোধন করে। আরামকোর সঙ্গে মিল রেখে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশেও মাসে মাসে এলপিজির দাম পুনঃনির্ধারিত হবে। মাসের নির্ধারিত সময়ে বিইআরসি তা জানিয়ে দেবে।
তিনি বলেন, বেসরকারি এলপিজি মজুদ ও বোতলজাতকরণ কোম্পানিগুলো ভোক্তা পর্যায়ে মূসক ছাড়া প্রতিকেজি ৭৬ টাকা ১২ পয়সা, মূসকসহ ৮১ টাকা ৩০ পয়সা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসাবে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ১২ কেজির বোতলের মূল্য হবে মূসকসহ ৯৭৫ টাকা।
এলপিজির নতুন এই মূল্যহার নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে বিইআরসি। এছাড়া জাতীয় পত্রিকায় বিষয়টি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে বলেও জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিইআরসির সদস্য মোহম্মদ আবু ফারুক, মকবুল ই ইলাহি চৌধুরী, মোহাম্মদ বজলুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান।
গত প্রায় তিন দশক ধরে দেশে এলপি গ্যাস বাজারজাতকরণ হয়ে থাকলেও এতোদিন সরকারিভাবে এর দাম নির্ধারিত ছিল না।
বর্তমানে দেশের একেক প্রান্তে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে এলপিজির বোতল। চাহিদা বেশি থাকায় রাজধানীতে এলপিজির দাম তুলনামূলক বেশি বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
রাজধানীতে ১২ কেজি বা সাড়ে ১২ কেজির একটি বোতলের খুচরা মূল্য ১০৫০ টাকা থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চেলের উপজেলাগুলোতে সাড়ে ৯০০ টাকায়ও মিলছে এলপিজির ১২ কেজির বোতল। এছাড়া ফিলিং স্টেশনগুলোতে প্রতিলিটার ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে অটোগ্যাস।
হাই কোর্টের আদেশ ও বিইআরসি আইনের ২২ (খ) ও ৩৪ ধারা অনুযায়ী গত ১৪ জানুয়ারি এলপিজির দাম নির্ধারণ নিয়ে গণশুনানি করে বিইআরসি। প্রায় ৩০ বা তার বেশি সংস্থার প্রতিনিধির সক্রিয় অংশগ্রহণে দিনব্যাপী এই শুনানি হয় ।
এরপরেও আগ্রহী পক্ষেগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করা হয়েছে বলে জানায় কমিশন।
গত বছরের ডিসেম্বরে বিইআরসিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। গণশুনানির আগে তাদের প্রস্তাব মূল্যায়ন করে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এরপর গণশুনানিতে সরবরাহকারী কোম্পানির প্রস্তাব, কারিগরি কমিটির মূল্যায়ন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে।
বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, বাসা-বাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয় বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো। আর সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করার কথা বলে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড (এলপিজিএল)। তবে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি জানায়, বেসরকারি খাতে ৮৬৬ টাকা ও সরকারি খাতে এলপিজিএলের দাম ৯০২ টাকা করা যেতে পারে।
বেসরকারি খাতে প্রায় ২০ বছর ধরে এলপি গ্যাসের ব্যবসা চলে আসছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে বাজারে এর চাহিদা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে ব্যবসার পরিধিও। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও গ্রাহকের জন্য এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতে পারেনি বিইআরসি। অবশেষে উচ্চ আদালতের আদেশে বাধ্য হয়ে দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করে বিইআরসি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) রিট আবেদনের ভিত্তিতে এক মাসের মধ্যে গণশুনানির মাধ্যমে দাম পুনর্নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে গত ২৫ আগস্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। নির্ধারিত ওই সময়ের মধ্যে দাম নির্ধারণ করতে না পারায় আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়ে সময় বাড়িয়ে নেয় বিইআরসি। ২০১৬ সালে জনস্বার্থে রিট আবেদনটি করেছিল ক্যাব।
এলপিজি মূলত প্রোপেন ও বিউটেনের মিশ্রিত জ্বালানি। সুষ্ঠু, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য স্থানীয় তাপমাত্রা অনুযায়ী এলপি গ্যাসে প্রোপেন ও বিউটেনের হার নির্ধারণ করা উচিত। কিন্তু দেশে এ রীতি অনুসরণ করা হয় না। বিইআরসির এ সংক্রান্ত সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় কোম্পানিগুলো ৩০ থেকে ৫০ ভাগ প্রোপেন এবং সে অনুসারে ৭০ থেকে ৫০ ভাগ বিউটেন মিশিয়ে এলপিজি বাজারজাত করছে। অথচ বাংলাদেশে এলপি গ্যাসে প্রোপেন-বিউটেনের অনুপাত ৩০ থেকে ৪০ এবং ৭০ থেকে ৬০ হওয়া উচিত।
দেশে বর্তমানে বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৫ হাজার টন সরকারি কোম্পানি বাজারজাত করছে। বাকি প্রায় ৯ লাখ ৮৫ হাজার টন আমদানি করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ২৮টি বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে ২০টি এলপিজি আমদানি করছে। এগুলোর বাইরে এলপি গ্যাস লিমিটেড একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এলপিজি বিপণন করছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম বর্তমানে গড়ে ১ হাজার ১০০ টাকা। আর সাড়ে ১২ কেজির সরকারি এলপি সিলিন্ডারের দাম ৬০০ টাকা। ব্যবহৃত এলপিজির ৮৪ শতাংশ যায় রান্নার কাজে। বাকি ১৬ শতাংশ পরিবহনের অটোগ্যাস, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ব্যবহার করা হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেড বোতলজাত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি বাজারজাত শুরু করে। ১৯৯৬ সালে এই ব্যবসায় যুক্ত হয় বেসরকারি উদ্যোক্তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ