পাকিস্তানে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সম্প্রতি পাকিস্তানের টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্য অশ্লীলতা ও নারীদের খোলামেলা পোশাককে দায়ী করেন। এমন মন্তব্য করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সমালোচকদের রোষের মুখে পড়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের এমন মন্তব্যকে “অত্যন্ত মূর্খতার পরিচয়” বলছেন দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘যেকোনো সমাজেই ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয় যে সেখানে অশ্লীলতা বেড়ে গেছে।’
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল জাজিরার খবরে বলা হয়, ওই সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নারীদের শালীন পোশাক পরার পরামর্শও দেন। তিনি বলেন, ‘পর্দা করার সারবস্তুই হলো আকর্ষণ করা থেকে বিরত থাকা। নিজেকে বিরত রাখার ইচ্ছাশক্তি সবার নেই।’
বিবিসি জানায়, টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত দুই ঘণ্টার ওই প্রশ্ন-উত্তর পর্বে ইমরান খানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যৌন নিপীড়ন বন্ধে তার সরকার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
উত্তরে তিনি প্রথমে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের নিন্দা করেন। এক পর্যায়ে বলেন, অশ্লীলতা বেড়ে যাওয়ার ফল হচ্ছে যৌন নৃশংসতা। এজন্য তিনি ভারত, পশ্চিমা ও হলিউডের সিনেমাকে দায়ী করেন।
সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার বলেন, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার যতগুলো ঘটনা গণমাধ্যমে আসে, সেগুলো প্রকৃত সংখ্যার এক শতাংশ মাত্র।
তিনি বলেন, সমাজে নির্লজ্জতার কারণে আজকাল বিয়ে-বিচ্ছেদের হার ৭০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ইসলামে পর্দাপ্রথার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘প্রলোভনকে আটকে রাখা’। সমাজে অনেকে রয়েছে, যারা ইচ্ছাশক্তি দমিয়ে রাখতে পারে না। এর কিছু প্রভাব তো পড়বেই!
তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তানের নারীদের উচিত প্রলোভন প্রতিরোধ করা। কারণ, সবার নিজেকে সংবরণ করার ইচ্ছাশক্তি থাকে না। তাই নারীদের পর্দা করা উচিত।”
ইমরান খানের ওই মন্তব্যের পর প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন অধিকার সংগঠন। অনলাইনে গতকাল বুধবার এ-সংক্রান্ত একটি বিবৃতিতে অনেকেই স্বাক্ষরও করেছেন। ওই বিবৃতিতে ইমরান খানের মন্তব্যকে ‘ত্রুটিপূর্ণ, রূঢ় ও বিপজ্জনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ধর্ষণের ঘটনার অপরাধ কেবলমাত্র ধর্ষকের ওপরই বর্তায় এবং (ইমরান খানের মন্তব্যের মতো) বক্তব্যের সংস্কৃতি ধর্ষককে উৎসাহিত করে।’
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, প্রধানমন্ত্রী ‘ধর্ষণ কে ক্ষমার চোখে’ দেখতে চাচ্ছেন। নিজের মন্তব্যের জন্য তারা ইমরান খানকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন এবং এ দাবির পক্ষে কয়েকশ স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছে।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনও প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছে, এর ফলে ধর্ষক, নিপীড়কদের রেহাই দিয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণ, নিপীড়নের শিকার সব নারীর ঘাড়ে দোষ চাপানো হলো।
এ বিষয়ে সাইকোলজি অব ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবি বলেন, ‘‘কোনো যৌনসুখ পাবার জন্য নয়, বরং অন্যপক্ষকে দমিয়ে রেখে ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ধর্ষণ করা হয়৷ ক্ষমতার এই প্রকাশ হতে পারে নারীদের বিপক্ষে, অথবা “উচ্চ স্থানে ওঠার” উপায় হিসাবে৷”
এছাড়া ধর্ষণের পেছনে নানা ধরনের মানসিক সমস্যাকেও দায়ী করেছেন তারা। ধর্ষণের সাথে পোশাকের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।’’
ইমরান খানের ওই মন্তব্যের পর সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। নারীদের নিরাপত্তা ও সমতার বিচারে বিশ্বের সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি পাকিস্তান। সেখানে তথাকথিত ‘অনার কিলিং’ এর নামে পরিবারের সদস্যরাই নারীদের নির্যাতন, ধর্ষণ এমনকি হত্যাও করে।
এর আগে গতবছর একটি গণমাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য নারীদের দায়ী করেছিলেন পাকিস্তানের এক ধর্মীয় নেতা৷ সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেও এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ না করায় তোপের মুখে পড়েছিলেন ইমরান খান।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে র্যালি বের করে কট্টরপন্থিদের রোষানলে পড়েন পাকিস্তানের নারীরা৷ অনলাইনে ভুয়া, বিকৃত ছবি আর ভিডিও ছড়িয়ে শুরু করা হয় অপপ্রচার৷ র্যালির আয়োজকরা তখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের হস্তক্ষেপ কামনা করেও কোনো সাড়া পাননি৷
পাকিস্তানে ধর্ষণ, নিপীড়ন প্রায় নিয়মিত ঘটনা৷ গত বছর এক নারীকে রাতে এক পেট্রোল পাম্পে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হতে হয়৷ নিজের সন্তানদের সামনে ধর্ষণের শিকার হওয়া ওই নারীকে এক পুলিশ কর্মকর্তা রাতে কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে বের হওয়ার কারণে ভর্ৎসনা করলে দেশ জুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ৷
পাকিস্তানের সরকারি হিসাব অনুসারে, দেশটিতে প্রতিদিন অন্তত ১১টি ধর্ষণের ঘটনার খবর পাওয়া যায়। সেখানে গত ছয় বছরে ২২ হাজারের বেশি ধর্ষণ মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ৭৭ জন অভিযুক্তের।
পাকিস্তানে প্রতি বছর বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা৷ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, নারীদের মত প্রকাশের অধিকার না থাকা এবং যর্থার্থ বিচার না হওয়ায় নারীর ওপর এই সহিংসতা বেড়েই চলেছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন৷
তারা বলেন, পাকিস্তান অভিশপ্ত দেশ। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। পাকিস্তানী সেনারা এখনও প্রতিনিয়ত বেলুচ, সিন্ধু ও গিলগিস্তান প্রদেশসহ বিভিন্ন প্রদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। এছাড়াও জঙ্গি উৎপাদনের প্রজনন কেন্দ্রও রয়েছে দেশটিতে।
তারা বলেন, নারীদের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সামাজিক নানা প্রথার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তারা সহিংসতা ও নির্যাতনকে নিজেদের জীবনের একটা অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছেন, এমনকি ধর্ষিতা হলেও তা মেনে নিচ্ছেন তারা৷ কেননা যারাই আইন আদালতের আশ্রয় নেন, সুবিচারের আশায় তাদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়৷
তারা জানান, পুলিশ ও আদালতের জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ে ৭০ ভাগ ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয় না৷ কেননা ধর্ষণের ঘটনায় দণ্ড প্রদানের ঘটনা বিরল, মাত্র ২ শতাংশ৷ তারা বলেন, ধর্ষণ এমন একটি ঘটনা যার বেদনা সারা জীবন বয়ে চলতে হয়, কিন্তু তারপরও যদি ধর্ষকদের শাস্তি হয়, তবে কিছুটা হলেও শান্তি পাওয়া যায়৷কিন্তু যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন কথা সেদেশে এর বিচার না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৮
আপনার মতামত জানানঃ