মাত্র একশো বছর ১৯২১ সালের আগেও ডায়াবেটিস রোগীরা এক কি দুই বছরের বেশি বাঁচতো না। মৃত্যুর হার ছিলো শতভাগ। কারণ এই রোগের কোনো প্রতিকার জানা ছিলো না। সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা ছিলো কঠিন ডায়েট। হয়তো সারাদিনে মাত্র ৪৫০ কিলো ক্যালোরি। এটা যে কতো কম সেটা বোঝার জন্য উল্লেখ্য যে এক স্লাইস পিজ্জা বা ছোট দু’টুকরো চিকেন ফ্রাইতে এর চাইতে বেশি ক্যালরি থাকে।
এতে করে বাঁচার জন্য অতিরিক্ত কয়েক বছর পাওয়া গেলেও, শেষমেশ বাঁচতো না কেউই। অনেকে তো এই কঠিন ডায়েটের কারণেই না খেয়ে মারা পড়তো। হাসপাতাল ভরে থাকতো মৃত্যুপথযাত্রী ডায়াবেটিস রোগী দিয়ে।
মানব ইতিহাসে ডায়াবেটিসের দৌরাত্ম্য
আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরীয় লিপিতে অত্যধিক মূত্র নির্গমন বলে ডায়াবেটিসের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম বর্ণিত রোগীটি টাইপ-১ ডায়াবেটিস বলে মনে করা হয়। প্রায় একই সময়ে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসকগণ রোগটির অস্তিত্ব খুঁজে পান এবং এই রোগীর মূত্র পিঁপড়াদের আকৃষ্ট করত দেখে তারা এই রোগের নাম দিয়েছিলেন মধুমেহ। সংস্কৃত ভাষায় মধু মানে শর্করা আর মেহ দ্বারা মূত্র বুঝায়।
গ্রিক চিকিৎসক অ্যাপোলোনিয়াস অব মেমফিস খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ সালে প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস শব্দটি ব্যবহার করেন। রোমান সাম্রাজ্যের সময় রোগটি বিরল ছিল। বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক গেইলেন মন্তব্য করেন যে তিনি তার পেশাগত জীবনে মাত্র দুজন ডায়াবেটিস রোগী দেখেছেন।
৪০০-৫০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে দুটি আলাদা রোগ হিসেবে সর্বপ্রথম শনাক্ত করেছিলেন দুই প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসক সুশ্রুত ও চরক যথাক্রমে তাদের সুশ্রুত সংহিতা ও চরক সংহিতা নামক পুস্তকে। সেখানে তারা বলেছিলেন টাইপ-১ তারুণ্য ও টাইপ-২ অধিক ওজনের সাথে সম্পর্কিত।
ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস নামে আরেকটি রোগ রয়েছে যেটিও বহুমূত্রের সাথে সম্পর্কিত তাই এই রোগ থেকে পৃথকীকরণের জন্য ডায়াবেটিসের সাথে মেলিটাস শব্দ যোগ করেন ব্রাইটন জন রোল নামে একজন বিজ্ঞানী।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের আগ পর্যন্ত এই রোগের ফলপ্রসু কোনো চিকিৎসা ছিল না। দুই কানাডীয় বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ব্যান্টিং ও চার্লস বেস্ট ১৯২১ ও ১৯২২ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। এরপর ১৯৪০ সালের দিকে দীর্ঘক্ষণ সক্রিয় নিউট্রাল প্রোটামিন হ্যাগেডর্ন (NPH) ইনসুলিন উদ্ভাবিত হয়।
রোগীকে অগ্ন্যাশয় খাওয়ানো!
সেই খ্রিস্টপূর্ব ৫৫২ সাল থেকে ডায়াবেটিসের কথা জানতো মানুষ। কিন্তু এর সমাধান তো দূরে থাক কারণটাই জানতো না কেউ। কতোজন কতো জায়গায় চেষ্টা করে যাছিলেন। কিন্তু আসলে কেউ ধরতেই পারছিলেন না যে আসলে কোন জিনিসটা দায়ী ডায়াবেটিসের জন্য।
১৮৮৯ সালে জার্মান গবেষক অস্কার মিনকস্কি আর জোসেফ ভন মেরিং দেখেন যে কুকুরের অগ্ন্যাশয় কেটে দিলে, সেটার ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেয় এবং সেটা মারা যায় কয়েকদিন পরেই। এখান থেকেই ধারণা করা হয় যে অগ্ন্যাশয় হল সেই উৎস যেটা থেকে কোনো একটা বস্তু বের হয় যা শরীরে ডায়াবেটিস হতে বাঁধা দেয়।
পরবর্তীতে ইউগাইন ওপিক দেখান যে পুরো অগ্ন্যাশয় না বরং এর ভিতরকার Islets of Langerhans নামের একটা বিশেষ কোষগুচ্ছই এর জন্য দায়ী। তিনি দেখান অগ্ন্যাশয় নষ্ট হলেও যদি আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স ঠিক থাকে, তাহলে ডায়াবেটিস হয় না, বরং উল্টো ক্ষেত্রে হয়। যে জিনিসটা এই কাজ করে তার নাম দেওয়া হয় ইন্টারনাল সাবসট্যান্স। এবার সবাই মিলে শুরু করলেন এই জিনিসটা খোঁজা। কিন্তু কেউই সফল হচ্ছিলেন না। এই আবিষ্কারের পরেই মূলত রোগীকে অগ্ন্যাশয় খাওয়ানোর ব্যাপারটা শুরু হয়। মাঝে মাঝে অগ্ন্যাশয় বেটেও খাওয়ানো হতো, বা রস বের করে সেই নির্যাস খাওয়া হতো।
কারো কারো ক্ষেত্রে কাজও হতো, কিন্তু সেই সাথে ভয়ানক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দিতো তাতে: বমি, জ্বর, খিঁচুনি, পেট খারাপ সহ আরও নানান উপসর্গ। অগ্ন্যাশয়ের রস বা নির্যাসের ইঞ্জেকশন ছিলো আরও ক্ষতিকর। কেউ কেউ বলতে লাগলো যে এই হাইপোথিসিস সম্ভবত ভুল। তবে ১৯১০ সালে স্যার এডওয়ার্ড এ্যালবার্ট শারপে দাবী করেন যে স্বভাবিক লোকের তুলনায় ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে শুধু একটা কেমিক্যালই নেই।
ফ্রেডরিক ব্যান্টিং ও চার্লস বেস্টের সাক্ষাৎ
যুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের ৩০ অক্টোবর রাতে ব্যান্টিং পাকস্থলী ও অন্ত্রের পেছনে অবস্থিত প্যাংক্রিয়াস গ্রন্থি সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখেন পিত্তাশয়ের পাথরের চাপে প্যাংক্রিয়াসের কিছু কোষ শুকিয়ে যায়। ফলে জারক রসের কোষগুলো বন্ধ হয়ে যায়। যাদের এমন হয় তাদের কখনও ডায়াবেটিস হয় না।
অধ্যাপক মোসেস বেরনের লেখা প্রবন্ধটি পড়ে ব্যান্টিং এর মনে হয় প্যাংক্রিয়াসের জারক রস আইলেটের হরমোনকে আকেজো করে দেয় এবং এ জন্যই প্রাণী ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হয়।
ব্যান্টিং ভাবেন, আইলেট নিসৃত হরমোনের অভাবেই যদি ডায়াবেটিস হয় তাহলে বাইরে থেকে আলাদাভাবে হরমোন প্রয়োগ করেও এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সেই থেকে শুরু হলো বেচারা ব্যান্টিং এর ভাবনা। সেই রাতের সিদ্ধান্তের কথা যদি পরদিন না মনে থাকে তাই ব্যান্টিং সেগুলো নোট খাতায় লিখে রাখেন- কুকুর নিয়ে গবেষণা করতে হবে। ওদের প্যাংক্রিয়াস বেঁধে রাখতে হবে এবং তা ক্ষয়ের জন্য ৬-৮ সপ্তাহ ওয়েট করতে হবে। পরে বাকি অংশ থেকে নির্যাস বের করতে হবে। ব্যান্টিং কিন্তু সেদিনও ভাবেনি যে তার লেখা নোটগুলো একদিন কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করবে।
পরদিন ব্যান্টিং সিদ্ধান্ত নেন সে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে গবেষণার কাজে সময় লাগাবেন। ব্যান্টিং তার ইচ্ছার কথা বিভাগীয় প্রধান ড.মিলার কে জানান এবং মিলার তাকে টরেন্টো মেডিকেল স্কুলের পরিচালক ডাক্তার জে. জে. ম্যাকলিয়ডের সাথে আলাপ করার পরামর্শ দেন। ডা.ম্যাকলিয়ড ছিলেন একজন অহংকারী দাম্ভিক গবেষক। ব্যান্টিং তার ইচ্ছার কথা ম্যাকলিয়ডকে জানালে ম্যাকলিয়ড তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন এবং বলেন, “বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা যেখানে সফল হয়নি তুমি এসেছো আমার সাথে মজা করতে। যাও পাগলের ডাক্তার দেখাও।”
ব্যান্টিং অনের কষ্ট পেয়েছিল কিন্তু হার মানেনি। কিছুদিন পর ব্যান্টিং আবার সেই একই ব্যক্তির কাছে হাজির হন কারন তা ছাড়া গবেষণার আর কোনো উন্নত ল্যাব ছিল না। এবার সে সাথে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশ নিয়ে আসেন, শুধুমাত্র ল্যাবরেটরির এক কোনে ঠাই পাবার জন্য। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। অহংকারী ম্যাকলিয়ড ব্যান্টিংকে কোনো সুযোগ দেননি। তার মনটা অনেক খারাপ হলো কিন্তু হার মানেনি।
এভাবে আরো কয়েক মাস কেটে গেল কিন্তু ব্যান্টিং আর গবেষণার জায়গা পেলেন না। একদিন ব্যান্টিং এক খবর শুনল যে ডাক্তার ম্যাকলিয়ড দু-মাসের জন্যে স্কটল্যান্ডে যাচ্ছেন যার কারনে ল্যাবরেটরি দুমাস বন্ধ থাকবে। ব্যান্টিং আবার সেই ম্যাকলিয়ডের কাছে যান, তাকে দুমাস ল্যাবরেটরি ব্যাবহারের করতে দেয়ার জন্য। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় এবার মনে হয় ম্যাকলিয়ডের মন কিছুটা হলেও নরম হয়। ম্যাকলিয়ড রাজি হলেন অবশেষে ব্যান্টিংকে ৮ সপ্তাহ কাজ করতে দিবে। তবে ল্যাবে নয় চিলেকোঠায় বসে কাজ করতে হবে। ব্যান্টিং মহাখুশি। কিন্তু ব্যান্টিংকে সাহায্য করবেন ম্যাকলিয়ডের এক ছাত্র যার নাম বেস্ট।
কুকুর নিয়ে সফল গবেষণা
১৯২১ সালের ৬ মে ব্যান্টিং ম্যাকলিয়ডের কাছে থেকে ল্যাবরেটরির দায়িত্ব পান। বেস্টের সাথে বোঝাপরা হতে থাকে। তারপর জটিল গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন নিজেকে।
৬ জুলাই কয়েকটি কুকুরের পেট চিরে ব্যান্টিং ওদের প্যাংক্রিয়াসের জারক রসবাহী শিরাগুলো বেঁধে দেন। একুশ দিন পর ২৭ জুলাই ব্যান্টিং আর বেস্ট মিলে কুকুরের পেট কেটে দেখেন যে সেই প্যাংক্রিয়াসগুলো শুকোয়নি-আগের মতোই সতেজ রয়েছে। তবে এটা তাদের ভুলের কারনেই হয়েছিল। তারা প্যাংক্রিয়াসের মুখগুলো ভালোভাবে বাঁধতে পারেননি। অন্যদিকে হাতে আছে ১ সপ্তাহ। এরপর ল্যাবরেটরি ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু একটি নতুন কাজ আরম্ভ করলে আরও অনেক দিন সময় লাগবে। ব্যান্টিং নতুন উপায় খুঁজছে। অনেক ভেবে আবার কয়েকটি কুকুরকে অপারেশন করেন তিনি এবং বেঁধে দেন প্যাংক্রিয়াসের শিরাগুলি। তিন সপ্তাহ পর আবার সেগুলো বের করে নেয় কুকুরের পেট থেকে। এবার ব্যান্টিং আনন্দে আত্মহারা। কুকুরের পেটে এবার প্যাংক্রিয়াস শুকিয়ে গিয়েছে মাত্র তিন সপ্তাহে যেখানে ৬-৭ সপ্তাহ লাগার কথা ছিল।
এবার ব্যান্টিং আর বেস্ট মিলে প্যাংক্রিয়াসগুলো পিষে তা থেকে একধরনের নির্যাস তৈরি করেন। তারা সেই পদার্থটির নাম দেন আইলেটিন। তারপর ৫ সি.সি পরিমান আইলেটিন বহুমূত্রে আক্রান্ত একটি কুকুরের শরীরে ঢুকিয়ে দেন। বেস্ট ঘন্টায় ঘন্টায় কুকুরের রক্ত আর প্রস্রাব পরিক্ষা করে চলেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, আইলেটিন প্রয়োগে কুকুরটির রক্ত ও প্রস্রাবে শর্করার পরিমান কমে এসেছে। কুকুরটিও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার মানে তাদের গবেষণা সফল হয়েছে।
গাভীর ভ্রূণ থেকে আইলেটিন প্রস্তুত
ডায়াবেটিস রোগের প্রতিরোধক হিসেবে আইলেটিন কার্যকর প্রমাণিত হলেও ব্যান্টিং ও বেস্ট তেমন খুশি হতে পারেননি। কারন এর কার্যক্ষমতা ছিল খুবই অল্প সময়ের। আর তার চেয়ে বড় কথা হলো একটি কুকুরকে একদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তা শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
এরপর ব্যান্টিং মনোযোগ দিলেন বই পড়ায়। তখন একটি চিকিৎসা সাময়িকী পড়ে সে জানতে পারলেন যে, শিশুরা যখন মাতৃগর্ভে ভ্রূণ অবস্থায় থাকে তখন তাদের জারক রসের প্রয়োজন হয় না। ফলে ভ্রূণের প্যাংক্রিয়াসে আইলেট অব ল্যাঙ্গারহান্সের পরিমাণ থাকে প্রাপ্তবয়স্ক প্রানীর চেয়ে বেশি।
প্রবন্ধটি পড়ে ব্যান্টিং অন্ধকারে আলোর দেখা পান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে প্যাংক্রিয়াস নিয়ে গবেষণা চালাবেন। শুরু হলো নতুন অভিযান। ব্যান্টিং কসাইখানা থেকে বেশ কিছু ভ্রূণ সংগ্রহ করেন। বেস্ট আর তিনি মিলে সেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ আইলেটিন তৈরি করেন। তারপর সেগুলো ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত কুকুরের শরীরে ঢুকিয়ে দেন। দু’দিন না যেতেই তারা দেখতে পান গাভীর ভ্রূণ থেকে প্রস্তুত আইলেটিন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সমানভাবে কার্যকর।
মানুষের উপর পরীক্ষা
ব্যান্টিং ও বেস্ট সিদ্ধান্ত নেন তাদের আবিস্কার এর কথা বাইরে প্রকাশ করবেন। তারপর এক রাতে ইয়েল ইউনিভার্সিটির শরীরতত্ত্ব বিভাগের জার্নাল ক্লাবের হলরুমে ম্যাজিক লণ্ঠনের আলো জ্বেলে তারা তাদের গবেষণার ফলাফল প্রদর্শন করেন। উপস্থিত চিকিৎসাবিদ এবং অধ্যাপকরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দেখে।
কিন্তু এর পরেই যখন অধ্যাপকরা জানতে চান ব্যান্টিং এর উদ্ভাবিত আইলেটিন মানুষের উপকারে আসবে কি না। ব্যান্টিং তখন বেশ সমস্যায় পড়েন। আর বেস্ট ছোট গলায় বলেন যে সে ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছেনা। তবে তারা গবেষণা চালিয়ে যাবেন।
এ ঘটনার পর ব্যান্টিং মানুষের উপর আইলেটিন এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কে রাজি হবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে! সে সময় টরেন্টো হাসপাতালে থমসন নামে ১৪ বছর বয়সের একজন ডায়াবেটিস রোগী ছিল। চিকিৎসকরা তার জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।তাকে প্রস্তাব দেয়া হলে ছেলেটি পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে রাজি হয়।
১৯২২ সালে ১১ জানুয়ারি ব্যান্টিং থমসনের শুকিয়ে যাওয়া হাতের শিরায় আইলেটিন প্রয়োগ করেন। দেখতে দেখতে মৃতপ্রায় থমসনের প্রস্রাব ও রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে আসে। মাত্র কয়েক দিনের চিকিৎসায় সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে যায়।
আইলেটিন নাম বদলে ইনসুলিন!
ব্যান্টিং আর বেস্টের সাফল্য দেখে এবার নিজের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য প্রথমেই আইলেটিন এর নাম বদলে দেন ম্যাকলিয়ড। তিনি এর নাম দেন ইনসুলিন। ১৯১৬ সালে হরমোন বিজ্ঞানী শেফার এই নামটি প্রস্তাব করেছিলেন। ডা. ম্যাকলিয়ডের কর্মকান্ডের মধ্যে ব্যান্টিং আর বেস্টের নাম হারিয়ে যায়।
ডায়াবেটিস রোগের প্রতিরোধক আবিষ্কারের জন্য ১৯২৩ সালে ব্যান্টিং এবং ম্যাকলিয়ডকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ডাক্তার ম্যাকলিয়ড পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তার প্রচার ও কৌশলের বিনিময়ে। কিন্তু এ পুরস্কারের প্রকৃত দাবিদার বেস্টকে রাখা হয় আলোর বাইরে।
ব্যান্টিং ম্যাকলিয়ডের এ আচরনের তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি নোবেল কমিটির কাছেও বেস্টের নামে সুপারিশ করেন। বেস্টকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বৈঠক করেন। কিন্তু তাতে আর কি লাভ। তারপর নিজের নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক টাকা বেস্টকে দেন ব্যান্টিং।
বাংলাদেশে বড়লোকের রোগ ডায়াবেটিস
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাব মতে, ২০১৯ সালে প্রতি ১১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন, যার মোট পরিমাণ ৪২৫ মিলিয়ন। ২০৪৫ সালে ৪৮ শতাংশ বেড়ে তা ৬২৯ মিলিয়ন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পৃথিবীর মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৮৭ শতাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বাস করছেন।
বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্থান শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে। পৃথিবীতে বর্তমানে উচ্চ হারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে।
অঞ্চল ভেদে মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কিছুটা চরিত্রগত ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রধানত টাইপ ২ ও অন্যান্য বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় প্রথমবার ডায়াবেটিস ধরা পড়ার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব দেশে। উন্নত দেশে নারীদের বেশি সংখ্যায় টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ভুগতে দেখা যায়, আর উন্নয়নশীল দেশে পুরুষেরা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে বেশি সংখ্যায় ভোগেন। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ২০১৮ সালে তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে প্রায় ৬৯ লাখ ২৫ হাজার ডায়াবেটিক রোগী রয়েছে, যা ২০৪৫ সালে এক কোটি ছাড়াবে।
বছরে বাড়ছে আরো ১ লাখ রোগী। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের ৫৭ শতাংশ লোক জানেন না যে তার ডায়াবেটিস রোগ আছে। বছরে এই রোগে প্রায় এক লাখ লোক মারা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে যারা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা নেন তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ ট্যাবলেট খান এবং প্রায় ১৭ ভাগ ইনসুলিন নেন। বাকি ১১ শতাংশের দুটোই প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস এসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং চিকিৎসক অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সকল ডায়াবেটিক রোগীকে ট্যাবলেট খেতেই হয়। যেহেতু এর সাথে অন্যান্য রোগ থাকে, এ ধরণের একটি রোগী কোন মতেই প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার নিচে চলতে পারবে না।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রাবেয়া আক্তার জানান, বছর দুয়েক আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার পর এখন নিয়ম করে দুই বেলা ঔষধ খেতে হয়। এখন প্রতিমাসে তার প্রায় দেড় হাজার টাকার মতো ঔষধ কিনতে হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের হিসেব অনুযায়ী ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এখন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। একজন রোগীর যদি প্রতিমাসে গড়ে দুই হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে সে হিসেবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে প্রতি মাসে ১৪ শত কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সচেতনতার মাধ্যমে যদি ডায়াবেটিসের বিস্তার কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে এ রোগের জন্য আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হবে। ডায়াবেটিস অন্য আরো নানা ধরনের রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চিকিৎসা ব্যয় বাড়তেই থাকে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২৩৫
আপনার মতামত জানানঃ