শাহাদাৎ হোসেন (২৪) নামের আলীয়া মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থী টানা ১৫ দিন ধরে ধর্ষণ করে আসছিল তার নিকট আরবি পড়তে আসা ৯ বছরের এক ছেলেকে। ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড তুমলিয়া গ্রামে। আজ সোমবার (০৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান নির্যাতনের শিকার ওই শিশুর পিতা।
অভিযুক্ত শাহাদাৎ উপজেলার তুমলিয়া গ্রামের মেজবাহ উদ্দিনের ছেলে। সে পাশের গ্রাম দুবার্টি আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও তুমলিয়া জামে মসজিদের সহকারী মোয়াজ্জিনের কাজ করে। আর নির্যাতনের শিকার ওই শিশুটি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত।
নির্যাতনের শিকার ওই শিশুর পিতা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, শাহাদাত আরবি পড়তে জানতো, তাই তাকে বলেছিলাম আমার বাড়িতে এসে আরবি পড়ানোর জন্য। তবে সে বাড়িতে এসে পড়াতে পারবে না বলে জানায় এবং তার বাড়িতে সন্ধ্যার পর পাঠাতে বলে। কথা মতো তার ছেলেকে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পাঠানো হতো শাহাদাতের বাড়িতে। তার ছেলেসহ আরো ১০/১৫ জন আরবি পড়তো শাহাদাতের কাছে। শাহাদাতের বাড়ির পাশে তার চাচার বাসার ২য় তলায় সবাইকে আরবি পড়াতো। গত ১ সপ্তাহ আগে তার ছেলে আরবি পড়তে যেতে অনীহা প্রকাশ করে এবং বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। ওইদিন পড়তে যেতে দেরি হওয়ায় বাড়িতে এসে খোঁজ নেয় শাহাদাত। পরে তার সাথে পাঠানো চেষ্টা করলে ছেলে কান্নাকাটি করে। এ সময় পরিবারের কাছে মূল ঘটনা খুলে বলে।
ছেলের বরাত দিয়ে তিনি আরো জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা বাজলে অন্য ছেলেদের ছুটি দিয়ে দিতো লম্পট শাহাদাত। পরে দু’তলার ওই রুমটি আটকে দিতো এবং জিনের ভয় দেখিয়ে তার ছেলেকে ধর্ষণ করতো। এ ঘটনা কাউকে বললে তার সাথে থাকা জিন শিশুটির ক্ষতি করবে বলেও ভয় দেখাতো শাহাদাত।
তিনি আরো জানান, বিষয়টি কালীগঞ্জ পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইব্রাহিম মোল্লা ওরফে চান্দু মোল্লা এবং ওই ওয়ার্ডের নব নির্বাচিত কাউন্সিলর আফছার আহমেদসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতৃবৃন্দকে জানানো হয়। তারা ১০/১৫ দিন আগে শালিস বসিয়ে শাহাদাতকে মারধর করে। বিচারে তিনি সন্তুষ্ট না হওয়ায় তিনি গাজীপুর এসপি’র কাছে যাওয়ার ভয় দেখান। পরে রোববার (০৪ এপ্রিল) দুপুরের দিকে আবার শালিস বসায়। এতে শাহাদাতকে বিচারকরা মাটিতে থুথু ফেলে চেটে তুলতে বলে ও ২০ বার কান ধরে উঠবস করায় এবং তাকে গ্রাম ছাড়া হতে বলে। তবে তিনি ওই কাউন্সিলরদের কথায় এবং নিজের সম্মানহানীর চিন্তা করে থানা পুলিশে যাননি বলেও জানান নির্যাতনের শিকার ওই শিশুর বাবা।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইব্রাহিম মোল্লা ওরফে চান্দু মোল্লা জাতীয় এক দৈনিককে জানান, এর আগেও ওই শাহাদাৎ জিনের ভয় দেখিয়ে পানি পড়া দিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। এখন আবার এ ঘটনা করলো। টাকা-পয়সা খরচ হবে বলে তাদেরকে থানা-পুলিশ যেতে নিরুৎসাহীত করেছি। তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে তাই নতুন কাউন্সিলর দায়িত্ব নিয়েছে বিচার করার তাই আমি আর কিছু বলিনি।
নব নির্বাচিত কাউন্সিলর আফছার আহমেদ ওই দৈনিককে জানান, আসলে বিষয়টি বড় করে দেখলে অনেক কিছু। আমরা গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে তার বিচার করে দিয়েছি। একবার বিচার করার পর নির্যাতনের শিকার পরিবার সন্তুষ্ট না হওয়ায় দু’তরফা বিচার করেছি। তাছাড়া নির্যাতনের শিকার শিশুটির বাবা থানা-পুলিশ না করে আমাকে বিচার করে দিতে বলেছিল। আর শালিসের সময় শুধু আমি না কাউন্সিলর চান্দু মোল্লা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতৃবৃন্দও ছিল। তবে এই বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি না করতেও প্রতিবেদককে তিনি অনুরোধ করেন।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ একেএম মিজানুল হক বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। যতদূর জানি বিষয়টি নিয়ে থানায় কেউ অভিযোগ করেননি। তবে অভিযোগ দিলে বিষয়টির ব্যাপারে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নিবেন বলেও জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা
বাংলাদেশে এখন ছেলে শিশু ধর্ষণ (বলাৎকার) উদ্বেগজনক হারে বড়ে গেছে৷ কিন্তু ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার তেমন কোনো নজির দেখা যায় না। প্রায় সমস্তটাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা মাতব্বর কর্তৃক শালিসে বিচারের মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। তবে এবিষয়ে আইনে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু নেই বলে অনেকে দাবি করলেও আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা ভুল ধারণা চলে আসছিলো যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শুধু নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হলেই বিচার করা যাবে৷ কিন্তু এই আইনের সংজ্ঞায় শিশু বলতে ছেলে বা মেয়ে আলাদা করা হয়নি৷ ১৬ বছর পর্যন্ত সব শিশুকেই বুঝানো হয়েছে৷ শিশু আইনেও শিশুদের কোনো লিঙ্গ ভাগ করা হয়নি৷ তাই ১৬ বছর পর্যন্ত কোনো ছেলে শিশু যদি ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে ধর্ষণ মামলাই হবে৷ যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, একশ্রেণির কিছু হায়নার দল যারা ধর্মীয় লেবাস গায়ে জড়িয়ে এসব কমলমতি শিশুদের দিনের পর দিন ধর্ষণ করে যাচ্ছে। অনেক সময় জানাজানি হলে সামান্য কিছু শাস্তি হয়, কিন্তু আবার তারা সমাজে একই কাজ করে যাচ্ছে বিচারহীনতার কারণে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে এক প্রকার জিম্মি করে দিনের পর দিন তারা একই কাজ করে যাচ্ছে এবং আমাদের সচেতন সমাজ এই মনে করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন যে তার সন্তান তো নিরাপদে রয়েছে।
তারা বলেন, শুধু আইন থাকলে হবে না প্রয়োজন কঠোর প্রয়োগ। শিশুদের প্রতি সহিংসতা নতুন নয়, হয়তো আরো ঘটবে আগামীতে। কিন্তু তা রোধ করতে পারে একমাত্র আইনের কঠোর প্রয়োগ। এই যেমন কঠোরতার কারণে এখন ‘এসিড সন্ত্রাস’ নেই বললেই চলে।
তারা বলেন, ধর্মীয় শিক্ষকরা তাদের শ্রদ্ধার আসনটি হারাতে বসেছেন তার কারণ তাদের নৈতিকস্খলন। যেটিই আগে ছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার, গর্ব করার বিষয়। বিবেকবোধের কারণে সমাজ তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন আর এখন দেখেন ঘৃণার চোখে। কারণ তাদের একটি অংশ শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনার সাথে অভিযুক্ত বা জড়িত। এ থেকে মুক্ত হতে না পারলে তার প্রভাব পড়বে পুরো সমাজেই।
এসডব্লিউ/ডিই/কেএইচ/২২১৩
আপনার মতামত জানানঃ