সামাজিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। পাশাপাশি মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে পারিবারিক সম্পর্কে অস্থিতিশীলতার খবর ছড়িয়ে পড়ছে গণমাধ্যমেও। সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপরও। নারী ও শিশু নির্যাতনের ধরন পাল্টানোর পাশাপাশি সহিংসতাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষত মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা আরও বেশি।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম ৩০ সেপ্টেম্বর তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট এই আট মাসে সারাদেশে ৫৭৪ জন কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ এছাড়া ৭৬ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এই শিশুরা পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সের৷ তবে অধিকাংশের বয়সই ১২ থেকে ১৪ বছর৷
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ধর্ষণের বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার বিধি থাকলেও কার্যকর হয় না৷
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, ‘‘এটা পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব৷ কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ৷ সামাজিকসহ নানা কারণে অনেক ঘটনায়ই মামলা হয় না৷ অনেক ঘটনা প্রকাশও করা হয় না৷”
এদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, গত বছর(২০২১) সারাদেশে ৮১৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ ২০২০ সালের তুলনায় যা ৩১ শতাংশ বেশি৷ বেশির ভাগ শিশু ধর্ষণ পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের মাধ্যমেই হয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে জানানো হয়৷ তারাও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতেই প্রতিবেদন তৈরি করেছে৷
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে গড়ে ৭২ টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ যা হারের দিক থেকে গত বছরের চেয়ে বেশি৷
শিশুরা পরিচিত পরিবেশে, পরিবারের মধ্যেই ধর্ষণের শিকার হয় বেশি৷ এটা অনেক সময়ই প্রকাশ হয় না৷ প্রকাশ হলেও নানা দিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত আপস হয়৷
অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, ‘‘গতকাল (সোমবার) গাইবন্ধায় পাঁচ বছরের একটি শিশুকে ৫৫ বছর বয়সের এক পুরুষ ধর্ষণ করেছে৷ এর আগেও সে আরো তিনবার ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছে৷ ছাড়া পেয়ে আবার ধর্ষণ করছে৷ তাহলে এটা থেকেই বোঝা যায় কেন শিশু ধর্ষণ বাড়ছে৷ আইন আছে, বিচার নেই৷ আবার শিশুরা পরিচিত পরিবেশে, পরিবারের মধ্যেই ধর্ষণের শিকার হয় বেশি৷ এটা অনেক সময়ই প্রকাশ হয় না৷ প্রকাশ হলেও নানা দিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত আপস হয়৷ ফলে শিশু ধর্ষণ বাড়ছেই৷”
তিনি বলেন, ‘‘শিশুরা সবচেয়ে দুর্বল৷ তারা বুঝতেও পারে না৷ পরিবার থেকে এব্যাপারে তাদের সচেতনও করা হয় না৷ আর পরিবারের লোকজন পরিচিতদের বিশ্বাস করে৷ যার পরিণতি নেমে আসে শিশুদের ওপর৷”
শিশু ধর্ষণের আশঙ্কাজনক এ চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারহীনতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত এ আতঙ্ক শিশুর মনোজগতে নানাভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, ‘‘২০১৪ সালের জরিপে দেখা যায় ধর্ষণের ৬০ ভাগ ঘটনায় থানায় কেউ অভিযোগ করে না৷ ২০১৬ সালে দেখা যায় মেয়েদের ৮০ ভাগ মামলা করতে যায় না৷”
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) এক বিবৃতিতে বলা হয়, যদিও অভিযুক্ত অপরাধীদের কাউকে কাউকে আটক করা হচ্ছে। কিন্তু এরা যে সবাই বিচারের মুখোমুখি হবে, সে কথা বলা যাচ্ছে না। এমজেএফ ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ২৫টি ধর্ষণ মামলা পর্যালোচনা করে দেখেছে, ২৫টি মামলার ২৫ জন আসামি ১৫ দিনের মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
শিশু ধর্ষণের উদ্বেগজনক এ পরিসংখ্যানে আশঙ্কায় রয়েছেন অনেকে। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন অনেক অভিভাবক। কেন বাড়ছে শিশু ধর্ষণের প্রবণতা- এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুশাসন নিশ্চিত তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা। যে কেউ কৃত অপরাধের সাজা পেলেই কমে আসতে পারে অপরাধ। তা না হলে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং পেশিশক্তির জোর দেখিয়ে দুর্বৃত্তরা যদি অপকর্ম করতেই থাকে তাহলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কামতোই বাড়তে থাকবে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা।
অপরাধীর বিবেক ঘুমিয়ে গেছে বলেই ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে আরও বড় অপরাধ করছে। হত্যা করছে ধর্ষিতাকে। জীবিত থাকা ধর্ষিতা সমাজ, আইনের সামনে নিজেকেই বারবার ‘ধর্ষিতা’ হতে দেখে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, নাজুক এ চক্র থেকে বেরোতে না পারলে শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেকে অজ্ঞতা আর সামাজিক মর্যাদা হানির আশঙ্কায় আদালত বা পুলিশের দোড়গোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। ফলে এসব অপরাধ ঘটছেই। এছাড়াও শিশু নির্যাতন বা নিপীড়ন বা ধর্ষনের মতো অপরাধ করে সহজে জামিন পাওয়া গেলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। পাশাপাশি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়। তাই আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার সামাজিক সচেতনতা ও মূল্যবোধ বৃদ্ধি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১১
আপনার মতামত জানানঃ