সমালোচনা যেন পিছু ছাড়ছে না কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিনা উসকানিতে সংঘাত সৃষ্টির পর এবার বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সংগঠনের তহবিল তছরুপের। এবার নিজস্ব তহবিলের লাখ লাখ টাকা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৩ সাল থেকে গত আট বছরে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচুর অনুদান এলেও এর কোনো হিসাব নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে হেফাজত নেতাদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও হেফাজতের প্রধান নিরীক্ষক (অডিটর) মাওলানা সলিমউল্লাহর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
মাওলানা সলিমউল্লাহ বলেন, রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচি ‘সফল’ করতে নানা উৎস থেকে টাকা নিয়েছিল সংগঠনটি। বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকাও সে সময় অন্তত ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেই অর্থ সহ অন্তত এক কোটি টাকার হিসাব দিতে পারেননি হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।
রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক-ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবি আদায়ে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক। দিনভর বিভিন্ন স্থাপনা, যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। পরদিন ৬ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় রাজধানীসহ রদশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হয়।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা ঘেরাও এবং এর অংশ হিসেবে শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচিতে অর্থ সহায়তা হিসেবে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাও নগদ ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন সংগঠনের তখনকার মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে। কিন্তু সেই টাকা নিজের কাছে রেখে দেন তিনি।’
মাওলানা সলিমউল্লাহ বলেন, ‘শাপলা চত্বরে আন্দোলন চলাকালে হুজুরকেও (হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ্ আহমদ শফী) অনেকে টাকা-পয়সা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো টাকা তিনি নিজের কাছে তেমন একটা রাখতেন না। একদিন হুজুর নিজ হাতে তখনকার মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে ২৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকাও তিনি হজম করে ফেলেছেন।’
শাপলা চত্বরে আন্দোলন চলাকালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছিল। কারাভোগের পর তিনি জামিনে বেরিয়ে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন।
মাওলানা সলিমউল্লাহ এ প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘জুনায়েদ বাবুনগরী হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালে একদিন তার মেয়ের এক ভাসুরকে পাঠান এবং তার মাধ্যমে চিকিৎসার কথা বলে সংগঠন থেকে ২০ লাখ টাকা নেন। সেই টাকা ফেরত দেওয়া দূরে থাক, কোনো হিসাবই দেননি তিনি। চিকিৎসার জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে; সেটাও কারও জানা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় সংগঠন থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছেন জুনায়েদ বাবুনগরী। সংগঠনের তৎকালীন মহাসচিব হিসেবেও অনেকে তার কাছে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এসব টাকার কোনো হিসাব নেই।’
দুর্নীতির অভিযোগ
গত ৭ বছর ধরে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আর্থিক সহায়তার কোনো হিসেবেই নেই। সদ্যপ্রয়াত সংগঠনটির প্রধান আল্লামা আহমদ শফী অন্তত ৫ বার কমিটি গঠন করেও সংগঠনের কোনো হিসাব বের করতে পারেননি। বারবার বর্তমান আমির এবং তৎকালীন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী কৌশলে কমিটিগুলো ভেঙে দিতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০১৬ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত হেফাজতের প্রধান নিরীক্ষক ছিলেন মাওলানা সলিমউল্লাহ। তবে জুনায়েদ বাবুনগরীর কাছ থেকে অর্থের হিসাব চাওয়া এবং এ বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করায় তাকে শেষ পর্যন্ত প্রধান নিরীক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বর্তমানে হেফাজতের যে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি রয়েছে, সে কমিটির অন্যতম সদস্য তিনি। অবশ্য কাগজ-কলমে নাম থাকলেও কয়েক মাস ধরে হেফাজতের সঙ্গে তেমন একটা সম্পৃক্ত নন ফটিকছড়ির নাজিরহাট আল জামিয়াতুল ফারুকীয়া মাদ্রাসার মুহতামিম (মহাপরিচালক) মাওলানা সলিমউল্লাহ।
আর্থিক অনিয়মের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে মাওলানা সলিমউল্লাহ বলেন, ‘২০১৬ সালে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ্ আহমদ শফী আমাকে হেফাজতের প্রধান নিরীক্ষক করে একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর সংগঠনের আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে গিয়ে দফায় দফায় বাধার মুখে পড়তে হয়। মূলত শাপলা চত্বরে আন্দোলনের সময় বিভিন্নভাবে নেওয়া টাকার হিসাব চাইতে গিয়ে এ সমস্যা তৈরি হয়। আমি বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি- সেটা মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী চাইতেন না। তাই যখনই আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরে নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করি, তখন পদাধিকারবলে আমার নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দেন তিনি।
যখন যাকে পছন্দ তাকে প্রধান নিরীক্ষকের দায়িত্ব দেন। অবশ্য কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে প্রধান নিরীক্ষকের পদ দেওয়া হতো। এভাবে তিনবার কমিটি পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে প্রধান নিরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের চাক্তাই মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা লোকমান হাকিম। আমি যখন প্রধান নিরীক্ষক ছিলাম, তখন সে কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। তবে বর্তমানে তথাকথিত হেফাজতের কমিটির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
শাহ্ আহমদ শফীর ঘনিষ্ঠভাজন ছিলেন মাওলানা সলিমউল্লাহ। কয়েক মাস আগেও ফটিকছড়ির আল জামেয়াতুল আরাবিয়া নছিরুল ইসলাম নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুহতামিম ছিলেন তিনি। তবে আহমদ শফী ইন্তেকাল করার পর তাকে সে পদ থেকে সরিয়ে দেন জুনায়েদ বাবুনগরী ও তার সমর্থকরা। তবে এর নেপথ্যে আরও গভীর রহস্য রয়েছে বলে মনে করেন মাওলানা সলিমউল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ মারা যাওয়ার পর ফটিকছড়ি মাইজভাণ্ডার শরীফের পীর মুজিবুল হক মাইজভাণ্ডারী ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য কওমিদের সমর্থন প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন তিনি। একাধিকবার আমার মাধ্যমে শফী হুজুরকে দিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ফোন করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেটা করিনি। এমন প্রেক্ষাপটে তার সঙ্গে বাবুনগরীর সুসম্পর্ক হয়। শফী হুজুর ইন্তেকাল করার পর তারা ষড়যন্ত্র করে আমাকে মাদ্রাসা থেকে সরিয়ে দেন।’
ফটিকছড়িতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি নামে একটি সংগঠন রয়েছে। প্রায় ২২ বছর ধরে জুনায়েদ বাবুনগরী সভাপতি ও সলিমউল্লাহ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও মাদ্রাসার পাশাপাশি সেই কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সলিমউল্লাহকে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে নারী নীতির বিরোধিতা করে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতেই গঠন হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তবে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রতিষ্ঠা হওয়া গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে প্রচারে আসে সংগঠনটি। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা আহমদ শফী মারা যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই কৌশলে আমির হন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩৪৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ