ব্রিটেনে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে অসুস্থদের মধ্যে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। খবর বিবিসি।
সূত্র মতে, দেশটিতে ২৪ মার্চের পর থেকে ১৮ মিলিয়ন মানুষ টিকা নেয়। তাদের মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে ৩০ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।
এটা এখনও নিশ্চিত নয় যে এটি কোন দুর্ঘটনা নাকি অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কোজ সুনিশ্চিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
যদিও ব্রিটেনের ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা পণ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা টিকা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, রোগীদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাকেই তারা সবথেকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়।
এদিকে জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস জানিয়েছে, ৬০ বছরের কম বয়সীদের তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দেবে না।
রক্ত জমাট বাঁধার অভিযোগে এর আগে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন স্থগিত করেছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো ইউরোপীয় ওষুধ সংস্থাও (ইএমএ) অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনকে নিরাপদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল।
গতকাল শুক্রবার এমএইচআরএ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩০ জনের মধ্যে ২২ জনের ক্ষেত্রেই সেরেব্রাল ভিনাস সাইনাস থ্রম্বোসিস হয়েছে, যা মস্তিস্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার এক বিরল রোগ।
এছাড়া অন্যরা রক্ত জমাট বাঁধা ও প্লেটলেট কমে যাওয়ার সমস্যায় ভুগেছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী ৮ জনের প্লেটলেট কম ছিল।
এমএইচআরএ-এর চিফ এক্সিকিউটিভ ড. জিন রেইন বলেন, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ রোধে এবং এর ভয়াবহতা কমাতে টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। তাই মানুষের উচিত এই সমস্ত ঘটনায় কান না দিয়ে নিজ নিজ টিকা নেয়া।
তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা মানুষের মধ্যে এই বিরল রক্ত জমাট বাঁধার রোগের কারণ কিনা তা নিয়ে তদন্ত চলছে। ইউরোপিয়ান ওষুধ এজেন্সি এই সপ্তাহের শুরুতে এ প্রসঙ্গে বলেছিল, ‘নিশ্চিত নয়, তবে সম্ভব।’
দু’টো বিষয় বেশ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশেষজ্ঞদের। প্রথমটা হচ্ছে রক্ত জমাট বাঁধার অস্বাভাবিক ধরন যার মধ্যে আছে প্লেটলেট কমে যাওয়া এবং রক্তে বিরল কিছু অ্যান্টিবডি যার সাথে অন্যান্য রক্ত জমাট বাঁধা রোগের যোগসূত্র আছে।
ইউসিএল ইন্সটিটিউট অব নিউরোলজি-এর অধ্যাপক ডেভিড রিং বলেন, এটা সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হতে পারে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এই বিরল এবং অস্বাভাবিক রোগ সেরিব্রাল ভেনাস সাইনাস থ্রম্বোসিসের (সিভিএসটি) কারণ। যদিও আমরা নিশ্চিত নই। জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা প্রয়োজন।
অন্য দুশ্চিন্তার বিষয়টি হলো অক্সফোর্ড-া এবং ফাইজার-বায়োএনটেক এর মধ্যকার পার্থক্য।
ব্রিটেনে ফাইজারের টিকা নেয়ার পর দু’জনের সিভিএসটিতে আক্রান্ত হয়। ফাইজারের টিকা দেয়া হয়েছে ১০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে এখানে পার্থক্যটা হলো, ফাইজারের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের কম প্লেটলেট ছিল না।
যাই হোক এই রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা কতোটা স্বাভাবিক তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। প্রতি মিলিয়নে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে দু’জনের শরীরে। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসে অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা সংক্রমিতদের শরীরে দেখা যায়। যা কিনা এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে আরও বেশি স্বাভাবিক করে তোলে।
জার্মানিতে এ অব্দি টিকা দেয়া হয়েছে ২.৭ মিলিয়ন মানুষকে। যার মধ্যে বিরল রোগ সিভিএসটিতে আক্রান্ত হয়েছে ৩১ জন। মৃত্যু হয়েছে নয় জনের। যাদের মধ্যে অধিকাংশই কম বয়সী এবং মধ্যবয়সী মহিলা।
লাভের তুলনায় ঝুঁকি কতটা?
প্রায় সব ধরনের ওষুধ, টিকা থেকে শুরু করে প্যারাসিটামল কোভিড-১৯ এ তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
করোনা রোগীর ক্ষেত্রে মৌসুমি ফ্লু-এর প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণকারী তীব্র পলিনিউরোপ্যাথি রোগ গুলেন বারি সিন্ড্রোমের কারণ হবার সম্ভাবনা এক মিলিয়নে একবার।
তাই এখানে মূল প্রশ্নটা হল, লাভের তুলনায় ঝুঁকি কতটা?
এমনকি যদি টিকা এই বিরল রোগের কারণ হয়ে থাকে, যা কিনা প্রমাণিত নয়, সেক্ষেত্রেও সংখ্যাটা দাঁড়ায় ২.৫ মিলিয়নে এক জনের মৃত্যু।
এটাকে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার সাথে তুলনা করা যাক।
যদি ২.৫ মিলিয়ন ৬০ বছর বয়সী মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়, তাহলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। যদি আক্রান্তের সবার বয় ৪০ বছরের আশেপাশে হয়, সেক্ষেত্রে মারা যাবে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষ।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে
একজন বিজ্ঞানী বলেন, টিকার কারণে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতার পেছনে কারণ হিসেবে বেশ কিছুকে দাঁড় করানো যায়। তবে একই সাথে এই ঝুঁকি টিকার সুরক্ষার তুলনায় অনেক কম।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট এঞ্জলিয়ার মাইক্রোবায়োলজিস্ট অধ্যাপক পল হান্টার বলেন, কোন নতুন টিকার ক্ষেত্রে এমন ক্লাস্টার অস্বাভাবিক নয়।
“কিন্তু যদি এই ক্লাস্টার এক অধিবাসী থেকে অন্য অধিবাসীতে ছড়ায়- যেমন প্রথমে এই রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল জার্মানিতে, এখন দেখা যাচ্ছে ব্রিটেনে, তখন সেই ক্লাস্টার আর কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থাকে না, সে সম্ভাবনা খুব কম।”
“পরিষ্কারভাবে আরও অনেক কাজ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রক্ত জমাট বাঁধার সাথে টিকার সম্পর্ক অনেকটাই স্পষ্টভাবে সামনে চলে আসছে।’’
এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা লিনডা বাউল্ড এ প্রসঙ্গে বলেন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
তিনি জনসাধারণকে টিকা নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, কোভিড-১৯ নিজে আক্রান্ত শরীরে রক্ত জমাট বাঁধায়। এটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে আমরা যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখছি, সেগুলোর।
সূত্র: বিবিসি
অনুবাদঃ সরকার শুভ্র
আপনার মতামত জানানঃ