শুভ্র সরকার :: বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং৷ হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোরেরা। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয়, সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় খেই হারিয়ে ফেলছে সমাজের কিশোর এবং তরুণেরা। হয়ে উঠছে অপরাধপ্রবণ।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আদনান কবির হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সামনে আসে৷ এর পর এসব গ্রুপের পরিধি বেড়েছে৷ ১৫-২০ বছর বয়সি কিশোরদের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ২০ জন করে সদস্য থাকে৷ ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে৷ প্রতিটি গ্যাং-এর সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন৷
কেন এই অপরাধ প্রবণতা?
এই কিশোরেরা সমাজের মধ্যে নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। ওই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ সবকিছু আলাদা। বিগবস, নাইন এমএম, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ইত্যাদি নামে গড়ে তুলছে অদ্ভূত এবং মারাত্মক ‘কিশোর গ্যাং’। যার ফলে সংঘটিত হচ্ছে নানাবিধ অপরাধ।
আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্যে মারামারি, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ঙ্কর মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, চাদাঁবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এমনকি খুনখারাবিসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে ভবিষ্যত সমাজের অপার সম্ভাবনাময়ী এসকল গ্যাং-এর তরুণ এবং কিশোর সদস্যরা। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা ‘অপরাধে’ আটক করা হচ্ছে৷
২০০৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী শিশু অপরাধীদের গড় বয়স ছিল ১৪ দশমিক ৯ বছর। মূলত পরিবারের আর্থিক অভাব, প্রাচুর্য, শিক্ষার অভাব, শাসনহীনতা, অভিভাবকের উদাসীনতা, মূল্যবোধের সংকট, পরিবারের ভিতরে অপরাধীর বা অপরাধের উপস্থিতি শিশুকে বিপদের মুখে এনে দাঁড় করায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবরাই শিশু কিশোরদের অপরাধ জগতের দিকে টেনে নিলেও, দরিদ্র শিশুদের খাবার ও আশ্রয়ের কথা বলে অপরাধীরা এই জগতে টেনে আনে। এছাড়া সমাজের মধ্যে বিরাজমান ফারাকও শিশুকে অপরাধী হতে পথ দেখায়।
এই শিশুদের শতকরা ৮০ জনই জানে যে তারা অপরাধ করছে। তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে যে অভাবের কারণেই তারা অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কিশোরীরাই সংখ্যায় বেশি।
বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে শিশু-কিশোরদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে। শহরের শিশু-কিশোররা পরিবার থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এর ফলে তারা মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও রাজনৈতিকভাবে কিশোরদের ব্যবহার করার কারণেও তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, টিকটক এবং লাইকিতে বিভিন্ন ধরনের কিশোর গ্যাং-এর পদচারণা এবং তাদের কর্মকাণ্ড সহজেই দৃশ্যমান হচ্ছে সমাজের মানুষের নিকট।
বাড়ছে কিশোর অপরাধের ঘটনা
রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, বাড্ডাসহ ঢাকার ৪০টি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্বে গত ১৭ বছরে ১২০ জন খুন হয়েছেন। গত দুই বছরে কিশোর অপরাধীদের হাতে মারা গেছে ৩৪ জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা চার কোটি। এদের মধ্যে এক কোটি ৩০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সাথে যুক্ত। আর অভাবের কারণে এদের অধিকাংশই নানারকম অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, শতকরা ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক চালানের সঙ্গে জড়িত, ৩৫ ভাগ জড়িত পিকেটিং এর সাথে, ১২ ভাগ জড়িত ছিনতাইয়ের সাথে, ১১ ভাগ জড়িত মানব পাচারের সাথে এবং ২১ ভাগ অন্যান্য অপরাধের সাথে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিশু মাদকে আসক্ত এবং এদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ তাদের মাদক গ্রহণের খরচ মেটাতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে অনেককে আগ্নেয়াস্ত্র বহন, হত্যা, মাদক চালান, ডাকাতি, চুরি, রাজনৈতিক সহিংসতা, যৌন হয়রানির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত আটক করেছে।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্য মতে যে কিশোররা ওইসব কেন্দ্রে আছে তাদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি৷ ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোররাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে৷ কিশোররা, চুরি, ছিনতায়ের মত অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে বলে কেন্দ্রের তথ্যে জানা যায়৷
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিসকো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির৷ তার পরের মাসে তেজকুনি পাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক৷ ঢাকার বাইরে থেকেও প্রায়ই কিশোর গ্যাং-এর দ্বন্দ্বে খুনখারাবির খবর পাওয়া যায়৷
বরগুনার নয়ন বন্ড তার ০০৭ গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এ হত্যার জন্যে ১১ কিশোরকে কারাদন্ড দিয়ে বরগুনার আদালত বলেছেন, ‘‘সারাদেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে৷ গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে৷’’
গত বছর সাভারে স্কুল ছাত্রী নীলা হত্যায় কিশোর গ্যাং জড়িত৷ আর ওই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মিজানুর রহমান কিশোর গ্যাং লিডার৷ আর তার গডফাদার স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা৷
ওই বছরের ৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে নাঈম নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়৷ একই এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় গত বছরের ১ এপ্রিল শরিফ হোসেন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷
সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও এখন কিশোর গ্যাং সক্রিয়৷ অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করেন৷ আর সেই ক্ষমতায় গ্যাংগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷ হত্যা ছাড়াও ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷
কেন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না কিশোর অপরাধ?
পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশে আইনের জটিলতা, জনবলের অভাব এবং অবকাঠামোর অভাবে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, কিশোর অপরাধ করলে মোবাইল কোর্ট করা যেতো, এখন হাইকোর্ট বলেছে না এটা করা যাবে না। মোবাইল কোর্ট করা যাবে না, নরমাল আদালতে বিচার করা যাবে না, জেলে রাখা যাবে না, রাখবো কোথায়? বিচারে পাঠাবো কোথায়?
তিনি বলেছিলেন, কিশোর অপরাধ দমনের জন্য পরিবারকে দায় নিতে হবে। পরিবার থেকেই সুশিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অবকাঠামোতে শিশু বা কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য অনেক সময় পদক্ষেপ নেয়া হলেও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে বেশিরভাগ সময়েই তা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, প্রশাসনিক কিছু জটিলতার কারণে দেখা যায় যে, কোন এক কর্মকর্তাকে শিশু বা কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে কিভাবে ডিল করতে হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনার পর হয়তো সে অন্য কোথাও বদলি হয়ে গেল। কিংবা ওই থানাতেই অন্য কোন দায়িত্বে চলে গেল। তখন আর ওই থানায় এ বিষয়ক প্রশিক্ষিত কোন কর্মকর্তা থাকে না।
প্রয়োজন সচেতনতা
শুধু দারিদ্রের কারণে নয়, অন্যান্য অনেক কারণেই সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধ জগতের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। আদনান হত্যাসহ আরও অনেকগুলো ঘটনা আজ আমাদের সামনে একথাই প্রমাণ করে। সচ্ছল পরিবারের বাবা মায়েরা তাদের ব্যস্ততা ও অসচেতনতার কারণে পারছে না সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে, তাদের যত্ন নিতে, তাদের কাজকর্মের প্রতি দৃষ্টি দিতে, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখার মত শিক্ষা দিতে। আর ব্যক্তিগতভাবে সময় দিতে না পারার এই ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে সন্তানের হাতে তুলে দেয়া হয় অপরিমিত অর্থ, প্রাচুর্য ও যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। যা তাদের সন্তানকে করে তোলে বেপরোয়া, দুর্বিনীত ও অপরাধী। সেইসব বখে যাওয়া শিশু কিশোররা যেমন সহজে এই মন্দ পথে পা বাড়ায়, তেমনি দাগী অপরাধীরাও খুব সহজে তাদের ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
বাবা মায়ের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও জীবনযাপন, কুশিক্ষা, অশিক্ষা, পরিবারের সদস্যদের অপরাধ করার প্রবণতা সচ্ছল ও অসচ্ছল দুই পরিবারের সন্তানকেই বিপদের মুখে ফেলে দেয়। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা নিজেরাই এতটা হতাশা, বিপদ ও জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে থাকে যে সন্তানের নৈতিকতা নিয়ে ভাবার সময় বা সুযোগ কোনটাই তাদের নেই। তবে ধনী ও সচ্ছল পরিবারের চিত্র কিন্তু ভিন্ন। এখানে অভিভাবক সন্তানকে সময় দেয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী থাকে। তারা মনে করে এটাই যথেষ্ট প্যারেন্টিং। কিন্তু আদতে ব্যাপারটা সেরকম নয়। আর তাই শিশু কিশোরদের হাতে থাকা গাড়ি, মটরসাইকেল, দামী ফোন, ঘড়ি, জামা কাপড় সবই ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধ কার্যক্রমের সাথে।
কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি কারণ তাদের ছেলেমেয়ে কার সাথে মিশছে, কিভাবে বড় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। পরিবারের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেও নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে কিশোরদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে।
শিশু কিশোরদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকতে হবে। কিশোরদের সমাজের ইতিবাচক কাজে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। তাই এর জন্য সমাজ ও দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রাখা চাই।
আগামী প্রজন্মের কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ এবং কলুষমুক্ত ও সুস্থ সমাজ গঠনে এখন থেকেই এই বিষয়ে সকলকে বিশেষ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎপর এবং যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। তাহলেই গ্যাং কালচারের এই বিপথগামী কিশোরদের অপরাধমুক্ত রাখা সম্ভবপর হবে এবং আগামী প্রজন্ম রক্ষা পাবে এক অসুস্থ সমাজ থেকে।
সমস্যা এবং সমাধান
কিশোর অপরাধ নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন৷ তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা আগেও ছিল, এখনও আছে৷ আগে তারা বখাটেপনা বা মেয়েদের উত্যক্ত করত৷ এখন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে৷ এর বড় কারণ পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা৷ এরপর বলব, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ নেই৷ আগে গ্রামের মুরুব্বিকে সবাই ভয় পেত৷ এখন নগরায়নের ফলে মুরুব্বিদের তারা ভয় পায় না, উল্টো মুরুব্বিরাই তাদের ভয় পায়৷
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও নানা কাজে ব্যস্ত থাকে৷ তারা এখানে খুব একটা মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না৷ পাশাপাশি এখন তো খেলার মাঠ নেই৷ তাই সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট৷ তারা ইন্টারনেটে মারামারির গেম খেলছে, হরর ফিল্ম দেখছে, এগুলো তাদের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে৷”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, একটা ঘটনা বলি, একটি ছেলে একটি মেয়েকে উত্যক্ত করত৷ মেয়েটির বড় বোন ছেলেটিকে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ এটি একটি রাস্তার উপরের ঘটনা৷ ছেলেটি মেয়েটির বোনকেও অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করল৷ ওই রাস্তা দিয়ে বহু মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন৷ কেউ প্রতিবাদ করলেন না৷ আসলে আগে অপরাধ করলে অপরাধীরা ভয়ে থাকত৷ আর এখন অপরাধীদের ভয়ে সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকেন৷
‘‘এইসব গ্যাং কালচারের কিশোরদের অধিকাংশই মাদকসেবী৷ মাদক এমন একটি জিনিস সেটা ব্রেনের নার্ভকে নষ্ট করে দেয়৷ ফলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে৷ বা মুহুর্তেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে৷ এসব কারণে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে এবং খুনোখুনির ঘটনা বেশি হচ্ছে৷”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড.তানিয়া রহমান বলছেন, বর্তমান সময়ের ব্যস্ততার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। এমনকি সন্তান কি করছেন, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, তাদের চাহিদা কী, এসব সম্পর্কেও তারা কোন খোঁজ রাখেন না।
“ফলে এই সন্তানরা বন্ধুদের কাছে আশ্রয় খোঁজে, তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করে। সেখানে তারা একই ধরণের মানসিকতা খুঁজে পায়, সাপোর্ট পায়। এভাবেই তাদের ছোট ছোট দল তৈরি হয়।”
তিনি জানান, পরে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে বা রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের স্বার্থে এই কিশোররা জড়িত হতে থাকে। অনেক সময় এলাকায় আধিপত্য দেখানো, সবার সামনে নিজেকে জাহির করার লোভ থেকে তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়ে।
“’দেখা যায়, ক্লাসের একজন বন্ধু কোন গ্যাংয়ের সদস্য হলে আরেক জনকে সেখানে সদস্য হতে প্রভাবিত করে। এধরণের ছেলেদের অন্যরা একটু ভয় পায়। ফলে সেটা তাদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষমতার মনোভাব তৈরি হয়। ফলে তারা গ্যাংয়ের সঙ্গে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে পড়ে।”
“পরে মাদক বা নিজেদের খরচ জোগাড় করতে তারা নানা অপরাধ করা শুরু করে। এরপর আর বেরিয়ে আসতে পারে না”, বলছেন অধ্যাপক তানিয়া রহমান।
অনেক সময় নিজেদের দল ভারি করতে প্রথম দিকে বিনামূল্যে মাদক সরবরাহ করে শিক্ষার্থীদের আসক্ত করে তোলা হয়। পরে তাদের গ্যাংয়ের সদস্য করে নেয়া হয়।
শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের অবস্থা
বাংলাদেশের গাজীপুরে দু’টি এবং যশোরে একটি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০ জনের৷ তাহলে বোঝা যায় আটক শিশুদের বড় একটি অংশ কারাগারেই থাকে, উন্নয়ন কেন্দ্রে জায়গা হয় না৷ উন্নয়ন কেন্দ্রে পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং অভিভাবকরা শিশুদের পাঠায়৷
গত বছর গাজীপুর ও যশোরের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ‘বিদ্রোহের’ পর তার প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান৷ তিনি দু’টি কেন্দ্রই পরিদর্শন করেন৷
তিনি জানান, ‘‘এই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর আগে নাম ছিল সংশোধন কেন্দ্র৷ নামের পরিবর্তন হলেও পরিবেশ বা ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি৷ শিশু-কিশোরদের পর্যাপ্ত খাবার, প্রয়োজনীয় পোশাক এবং শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয় না৷ ফলে তাদের উন্নয়ন বা সংশোধন না হয়ে তারা বরং ‘অপরাধী’ হয়ে উঠতে পারে৷”
তিনি বলেন, ‘‘দেশে বর্তমান শিশু আইনটি যথেষ্ট ভালো হলেও এর প্রয়োগ তেমন নেই৷ অনেক শিশুকেই বড়দের সাথে কারাগারে রাখা হয়৷ আবার নয় বছরের নীচের শিশুকেও আটক করা হয়৷”
তিনি তার গবেষণার আলোকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে শিশুরা প্রধানত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অপরাধী চক্রের কারণে৷ তারা শিশুদের ব্যবহার করে৷ এছাড়া পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থার কারণেও তারা অপরাধে জড়ায় না জেনে৷ বাংলাদেশের শিশুদের একটি অংশ শেকড়হীন, পথ শিশু, তারাই অপরাধী চক্রের প্রধান টার্গেট৷”
শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘শিশুদের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে৷ উন্নয়ন কেন্দ্র বা জেলখানা নয়, তাদের সত্যিকার অর্থেই পারিবারিক পরিবেশে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে৷”
এসডব্লিউ/এসএস/২২৫৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ