কবির হোসেন :: ঘোর অন্ধকারে এক টুকরো আগুন আলো ছড়িয়ে দিলেও আগুন সবসময় আলো ছড়ায় না, কোথাও কোথাও ঘোর অন্ধকারও বয়ে আনে। যে সংগীত আমাদের অন্তরে আলো বয়ে আনে, ছড়িয়ে দেয় বিশ্বলোকে, সেখানে আগুন পড়লে সমস্ত আলোই পুড়ে ক্রমশ অন্ধকার বয়ে আনে। কথা বলছিলাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন নিয়ে। ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় অবস্থিত এই সংগীতাঙ্গন একটি লাইট হাউজ হতে পারত, তা না হয়ে হয়ে উঠেছে যেন ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের চক্ষুশূল। তাইতো তাদের বারবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া প্রতিষ্ঠানটি নীরবে নিভৃতে চাপাস্বরে গান গায়। আর সেই গান থেকে ছড়িয়ে পড়ে পোড়া দুর্গন্ধ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন কেন মৌলবাদীদের চক্ষুশূল? কেন বারবার হামলা আগুন ভাংচুরের লক্ষ্যবস্তু হয় এই প্রতিষ্ঠানটি?
সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ
বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদী সঙ্গীত জগতের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তিনিই প্রথম বাঙালি সুরসাধক যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিত ও প্রচার করেন। ধ্রুপদী সঙ্গীতের বোদ্ধাগণ সংশয়হীনভাবে স্বীকার করেন, অতি উচ্চমানের সঙ্গীত কলাকার ছিলেন তিনি।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ মতান্তরে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুরে এক সঙ্গীতপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আলাউদ্দিনের ডাক নাম ছিল ‘আলম’। তার পিতার নাম সাবদার হোসেন খান। স্থানীয় লোকেরা তাকে সাধু খাঁ নামে ডাকতেন। তার পিতাও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। মাতার নাম সুন্দরী বেগম। তার সঙ্গীত গুরু ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভাসঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের কন্যাবংশীয় রবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ। তার অপর দুই ভাই হলেন―ওস্তাদ আফতাব উদ্দীন খাঁ (তবলা ও বংশীবাদক) এবং ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ (সুরবাহার বাদক)।
প্রখ্যাত সঙ্গীতসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাবা আলাউদ্দিন খান নামেও পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ইতিহাসে বহুদিন কোনো বাঙালির নাম ছিল না। এই শূন্যতা পূরণ করলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে আলাউদ্দিন খাঁ। সঙ্গীতের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় তিনি শৈশবেই বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। তারপর নিরন্তর সাধনার সুদীর্ঘ যন্ত্রণাকাতর পথ বেয়ে তিনি বাংলার সীমা ছাড়িয়ে হয়ে উঠলেন সর্বভারতীয় এক গৌরব। মূলত সরোদ-বাদক হলেও ধ্রুপদী সঙ্গীতের নানা ক্ষেত্রে এক অনুসরণীয় গুরু। তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছে প্রসিদ্ধ মাইহার ঘরানা। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ভারতীয় চিরায়ত সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের যন্ত্র তিনি কুশলতার সাথে বাজাতে পারতেন। তার শিষ্যদের দিকে তাকালে, বাদ্যযন্ত্রের সমাহার যে দেখা যায়, তার বিচারে তাকে অতিমানবীয় গুণের অধিকারী বলে মনে হয়। তিনি তার পুত্র ওস্তাদআলী আকবর খানকে সরোদ, পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও নিখিল বন্দোপাধ্যায়কে সেতার, কন্যা বিদুষী অন্নপূর্ণাকে সুরবাহার, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ ও বিজনাথ ঘোষ কে বাঁশি, পণ্ডিত রবীন ঘোষকে বেহালা শিখিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এরা সবাই জগৎবিখ্যাত হয়েছেন।
তিনি দেশিয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অর্কেস্ট্রার স্টাইলে একটি যন্ত্রীদল গঠন করে নাম দেন ‘রামপুর স্ট্রিং ব্যান্ড’।
ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে। অতঃপর ভারত সরকার তাকে একে একে ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমী সম্মান’ (১৯৫২), ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৫৮) ও ‘পদ্মবিভূষণ’ (১৯৭১); বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ‘দেশিকোত্তম’ (১৯৬১) এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৫৪ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক প্রথম সঙ্গীত নাটক আকাদেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল তাকে আজীবন সদস্যপদ দান করে। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এসব দুর্লভ সম্মান ও খেতাব সঙ্গীতবিদ্যায় আলাউদ্দিন খাঁর অসাধারণ কীর্তি ও সাফল্যকেই সূচিত করে।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন
জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুরগ্রামেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মা-বাবার কবর। বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁর সমাধি ও নিজের হাতে গড়া একটি মসজিদ রয়েছে সেখানে। জেলা শহরে আছে একটি বাড়ি, যা ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’ নামে পরিচিত।
শিবপুর গ্রামে বিশ্বখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছাড়াও তার ছোট ভাই সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, বড় ভাই ‘মলয়া’ গানের সুরস্রষ্টা ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁ, প্রখ্যাত সুরকার শেখ সাদী খান, রাজা হোসেন খান, সরোদশিল্পী ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খানসহ অনেক সংগীতজ্ঞ জন্মগ্রহণ করেন।
জানা যায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাদাসিধে ও ভীষণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। অর্থের প্রতি কোনো ধরনের লোভ ছিল না তার। অনেক বড় বড় দরবার থেকে (হায়দরাবাদ, কাশ্মীর) মোটা টাকার চাকরির আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কিন্তু মাইহারের সামান্য টাকার চাকরি ছেড়ে সেসব জায়গায় যাননি তিনি। সুরের নেশায় ছোটবেলায় স্কুল পালিয়েছেন, বাড়ি ছেড়েছেন দুবার। সুরের টানে গেছেন কলকাতায়। কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের নাচের দলের সঙ্গে ভ্রমণ করেছেন ইউরোপে।
১৯৫৬ সালে আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাস করার ইচ্ছায় শহরের পুরাতন জেল রোডের বাড়িটি আলাউদ্দিন খাঁ কিনে নেন। সেই বাড়িই এখন ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’, যেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি জাদুঘর’। ১৯৭৩ সালে বাড়িটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই সংগীত অ্যাকাডেমি ও জাদুঘর। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান এটি উদ্বোধন করেন। এই সংগীতাঙ্গনে কণ্ঠ, যন্ত্রসংগীত, চিত্রাঙ্কন ও নৃত্যকলা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মৌলবাদীদের প্রথম তাণ্ডব
২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর সংগীতাঙ্গন প্রথম মৌলবাদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এক মাদ্রাসাছাত্রের নিহতের ঘটনায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বত্র। ভাঙচুর চালানো হয় রেলওয়ে স্টেশন, দোকানপাট, বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় রেললাইনে। তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’, ‘সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি জাদুঘর’এ। হামলা চালিয়ে তা সম্পুর্ণ ধ্বংস করা হয়।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তার দীর্ঘ জীবনে বহু জায়গায় সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। সেসব স্মৃতির ছবিগুলো ধরে রাখা ছিল যাদুঘরের এই গ্যালারিতে। ওই হামলায় আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বহু জিনিসপত্র ভাঙচুর হয়েছে, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে এবং লুট হয়েছে।
এখানে পড়ে আছে তার ব্যবহারের একজোড়া বায়া তবলা। যাদুঘরের ভেতরে যেমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তেমনি যাদুঘরের বাইরে রাখা সম্পত্তিরও ক্ষতি করা হয়েছে।
শহরের হালদারপাড়া এলাকায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চক্বর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিল্পকলা অ্যাকাডেমি ভবনটি এখানেই। এই ভবনে ছিল বেশ ক’টি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সবগুলোই হামলায় ভাঙচুরের শিকার হয়। লুট করা হয় কম্পিউটারসহ নানা জিনিসপত্র।
আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন সূত্রে জানা গেছে, কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত এবং চিত্রাঙ্কন ও নৃত্যকলা বিষয়ে এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে এখানে চার শ শিক্ষার্থী আছে। এ মিলনায়তন শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজেদের অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করে।
সূত্র জানায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘরে আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত দুটি সরোদ, দুটি বেহালা, একটি সন্তুর, একটি ব্যাঞ্জো ও একটি সারেঙ্গি, তার হাতে লেখা অন্তত ২৫টি চিঠি, হজের সময় সৌদি আরবের বাদশাহর দেওয়া জায়নামাজ, ব্রিটিশ শাসনাধীন তৎকালীন ভারতের দেশীয় রাজ্য মাইহারের রাজা বৃজনাথ সিংয়ের দেওয়া রেওয়াজের দুটি গালিচা, তার নিজের একটি বড় ছবি এবং দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান ও বিশ্ব ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তোলা অন্তত এক হাজার দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র ও আলোকচিত্রের অনুলিপি ছিল। আগুনের গ্রাসে প্রায় সবই গেছে।
সংস্কৃতি ও সংগীতপ্রেমী সকলেই হতবিহ্বল হয়েছেন ১২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসাছাত্রদের হাতে আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। এ ঘটনাকে তারা দেখছেন ২০০১ সালের আফগানিস্তানের বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের পর শিল্প-সংস্কৃতির জগতের ওপর নেমে আসা সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ হিসেবে। মাইহার ঘরানার প্রবক্তা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে এবং সুযোগ্য শিষ্যা অন্নপূর্ণার কাছে শিক্ষা নেওয়া পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া বেদনার্ত হয়ে বলেছেন, ‘এটা মানবতার মৃত্যু। ওই ধরনের ঘটনা সামাজিক কাঠামোকেই বিপর্যস্ত করে।
পণ্ডিত যশরাজের প্রতিক্রিয়া বিস্ময়মাখা, ‘বাংলাদেশ সংগীত এত ভালোবাসে। সেখানে এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? হামলাকারীরা কোনো ভুলপথে চালিত হয়েছে। কী ধ্বংস করছে, ওরা তা জানত না।’
ওস্তাদ রশিদ খাঁ সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে মনুষ্যত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, ‘মানুষ কীভাবে এতটা নিচে নামতে পারে! শিল্পীরা সব জায়গাতেই সহজ নিশানা হয়ে যাচ্ছেন। মৃতদের স্মৃতিকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’
ফেব্রুয়ারি মাসে পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের আসার কথা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘সংগীতাঙ্গনে’। অগ্নিকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ তাকে হকচকিত করেছে। তিনি বলেছেন, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাহিবের মাইহার ঘরানার শিল্পী আমি। তার সব স্মৃতি এভাবে ছাই হয়ে গেছে জেনে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে। বামিয়ান বুদ্ধমূর্তির ওপর তালেবান হানার মতোই ভয়াবহ এই ঘটনা।’
ঝলসে উঠেছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নাতি ও ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর ছেলে আশীষ খাঁ। বলেছেন, ‘এটা লজ্জাজনক ঘটনা। আসলে বাংলাদেশ কখনোই দাদুকে যোগ্য সম্মান দেয়নি। মর্মাহত বোধ করছি। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিক সরকার।’ উপমহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য এসব শিল্পী তাদের ক্ষোভ ও কান্না ব্যক্ত করেছেন কলকাতার অনলাইন সংবাদপত্র ‘এই সময়’-এর ১৯ জানুয়ারি সংখ্যায়।
মৌলবাদীদের দ্বিতীয় তাণ্ডব
প্রথম তাণ্ডবের ক্ষত কখনোই সারবার নয়, এরইমধ্যে মৌলবাদীদের দ্বিতীয় তাণ্ডবে পুড়েছে শুদ্ধ সংগীত চর্চাকেন্দ্র সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন। গত রবিবার (২৮ মার্চ) হেফাজতের তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরাতন জেল রোডের প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। অনেক দুর্লভ নথিপত্রসহ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজরিত অনেক বাদ্যযন্ত্র পুড়ে যায়। এবার প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি কক্ষে বেছে বেছে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ছয়টি কক্ষের মধ্যে একটি জাদুঘর, তিনটি ক্লাসরুম, মুক্ত আলোচনার সরোদ মঞ্চ, প্রশাসনিক কক্ষ ও স্টোররুমে থাকা বাদ্যযন্ত্র, চেয়ার-টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্র সবকিছু ভেঙে তছনছ করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দুই শতাধিক হরতাল–সমর্থক ভেতরে গিয়ে প্রথমে নথিপত্রে পেট্রল ঢালেন। পরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
২০১৬ সালেও মাদ্রাসাছাত্ররা সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, এবার সুরসম্রাটের স্মৃতিধারক কোনোকিছু আর অবশিষ্ট থাকলো না।
সুরের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানে স্থানে এখন স্পষ্ট হরতাল–সমর্থকদের হামলার ক্ষতচিহ্ন। শুধু তা–ই নয়, জেলা শহরের বাইরে তাণ্ডব চলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর আশুগঞ্জ প্রান্তের টোল প্লাজা। একই স্থানের পুলিশ বক্সেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা করে সারাদেশেই হেফাজত ইসলাম বিক্ষোভ বিদ্রোহ করে। রাজধানী ঢাকা শহরের দাবানলে পুলিশি আক্রমণে আহত হলে পরে তা ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারি ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায়। শুক্রবার হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গত রোববার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে হেফাজতে ইসলাম। এই হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গত রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে তিন দিনের সহিংস বিক্ষোভে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন।
সঙ্গীতাঙ্গনের নৃত্য প্রশিক্ষক জিয়া আমীন বলেন, সংস্কৃতি ও সংগীতের রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে বারবার হামলার ঘটনায় মন ভেঙেছে আমাদের। প্রতিবার কেন প্রতিষ্ঠানটিতে বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে। আমরা এই ঘটনার বিচার কার কাছে চাইবো। অতীতে বিচার পাইনি, হয়তো এবারো পাবো না। তবে এসব করে মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির চর্চা স্তব্ধ করা যাবে না।
প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা প্রহরী ও প্রবীন্দ্র দাস বলেন, আমি প্রতিষ্ঠানটির একটি কক্ষে থাকি। বর্তমানে ঘরগুলো ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আর কিছু রক্ষিত নেই। হরতাল পালনকারীদের ভয়ে কেউ আগুন নেভাতে এগিয়ে আসেনি বলেও জানান তিনি।
প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক নাট্যব্যক্তিত্ব মঞ্জুরুল আলম বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে থাকা অতি দুর্লভ আড়াইশ’ বই, আড়াই হাজার ছবি, দলিলপত্র, আলাউদ্দিন খাঁর লেখা সংগীতের পাণ্ডলিপি, দুর্লভ ছবি, সংগীতের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি হারমোনিয়াম, সেতার, তবলা, বেহালা, খুঞ্জন ও বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র সরোদ ছিল। সব মিলিয়ে অন্তত ৩৫ লাখ টাকার যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এবারের হামলা ছিল অতীতের যেকোনও হামলার চেয়ে বর্বর। যারা মুক্ত চিন্তা ও শুদ্ধ বুদ্ধির সংগীত চর্চা পছন্দ করেন না, তারাই এ হামলা চালিয়েছে।
এদিকে হামলার ঘটনায় মন ভেঙেছে শিল্পী, সংগীত প্রশিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের। নাট্যব্যক্তিত্ব মঞ্জুরুল আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত ২০১৬ সালেও মাদ্রাসাছাত্ররা এখানে আগুন দিয়েছিল। সেসময়ে দুর্বৃত্তরা সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। এবার সুরসম্রাটের স্মৃতিধারক কোনোকিছু আর অবশিষ্ট থাকলো না। তিনি অতীত ও বর্তমান হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
আগেও অন্তত দুবার এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিল এই মৌলবাদী চক্র, সেই ঘটনা ১৯৯৮ ও ২০০১ সালের। সেই দুবার কয়েক দফা তাণ্ডবের পরও সাংস্কৃতিক কোনো প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়নি। তখন তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল বিক্ষিপ্ত। এবারের হামলার মূল লক্ষ্য ছিল কলাকেন্দ্রগুলো।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উগ্র ধর্মান্ধ, ঘোর সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী-ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর ইন্ধনে একটি আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপার অতি বড় ঘটনার রূপ দিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ। উদ্দেশ্য? তাদের আসল লক্ষ্য হল, সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপকতর প্রসার এবং জঙ্গিবাদের নবউত্থান ঘটিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করা। আর এটা বুঝেও যদি রাজনৈতিক দলগুলি (ক্ষমতামান দলটিসহ) চুপচাপই থাকেন, তবে বলতেই হবে, সামনে ঘোর দুর্দিন বাঙালি জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।
তারা বলেন, আমাদের এখন এমন চেতনা ও রাজনীতি দরকার, যা জীবন আর সংস্কৃতিকে এক করে দেখবে ও বাঁচাবে। মানুষই সংস্কৃতির জন্ম দেয়, সংস্কৃতিরই দায় মানুষের পক্ষে থাকবার।
তারা বলেন, প্রাণের চেয়ে বড় ক্ষতি নেই। বিগত জীবন আর ফিরে আসে না। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনের স্মৃতিচিহ্নগুলোও ফিরে আসবে না। মাদ্রাসাছাত্রদের প্রাণও প্রাণ, সে-ও বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে হামলার শিকার হয়ে।
তারা বলেন, বলপ্রয়োগের পথ ছাড়া উত্তেজনা মোকাবিলার আর কোনো পথ তাদের জানা নেই। প্রতিষ্ঠিত আইন-রাজনীতি ও নৈতিকতা যখন মানুষের অসন্তোষ মেটাতে পারে না, তখনই প্রান্তিক জনসাধারণ ওই সভ্যতা ও নৈতিকতা ত্যাগ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমরা এটাই দেখেছি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যদি আদব ও নৈতিকতায় নিজেদের উন্নত ভাবেন, তাহলে কী করে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মতো ভাঙচুরের পথে যান? ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারেবারেই এ ধরনের সহিংসতার কবলে পড়েছে, বারেবারেই মাদ্রাসাছাত্ররা সেখানে সহিংসতার হাতিয়ার ও শিকার দুটোই হয়েছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতা এই, এখানে বলপ্রয়োগ বা পাল্টা সহিংসতা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিকতা, শাসনতরিকা বা প্রতিবাদের উপায় কারও জানা নেই। সমাজে ও রাজনীতিতে তাই আদিম হিংসার নৃত্য দেখা যাচ্ছে। এই আদিমতা আসলে ক্ষমতা দেখানোর আদিম অভ্যাসেরই আয়না-ছবি। ক্ষমতা যখন মানুষকে অসহায় করে তোলে, তখন সেই সব মানুষ নির্ভয় ও নির্লজ্জ হয়ে পাল্টা ক্ষমতা জাহির করে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৪১৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ