বিশেষ প্রতিনিধি :: দেবে না তোমরা ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি? বাংলাদেশের মানুষগুলোকে সহায়তা দিতে বিটলস গায়কদের অন্যতম জর্জ হ্যারিসন ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ গেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তোলপাড় করা এই গানটি – বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। তার এই আবেদন যেন শুধু সেই সময়ের উপর দাঁড়িয়ে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মানুষের সাহায্যের প্রত্যাশা নয়, বরং আগত ভবিষ্যতে বাংলাদেশিদের উপর যে অকথ্য নির্মম অত্যাচার চলেছিল, তারও যেন পূর্বাভাস। ওই একই বছর ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে সাথেই, পাক হানাদার বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মাটিতে মিশিয়ে দিতে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে মারা যায় প্রায় ৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ। এর সাথে সাথেই বিধ্বংসী বন্যা, সাইক্লোনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নতুন এই দেশটাকে পৃথিবীর সবথেকে সমস্যাপ্রবণ জায়গা করে তোলে।
৫০ বছরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের যে পরিবর্তন, যে উন্নয়ন— তা বিশ্বকে বিস্মিত করে দেয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি জিডিপি পাকিস্তানের থেকে ৪০ শতাংশ কম ছিল। এখন সেটি ৪০ শতাংশের থেকেও বেশি। করোনা মহামারীর আগে প্রতিবছর দেশটির অর্থনীতি প্রায় ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এশিয়ার যেকোন দেশের চেয়ে এটিই দ্রুততম বৃদ্ধির হার। দেশটির গার্মেন্টস কারখানাগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ সম্প্রতি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। যা কিনা ১৯৭১ সালের পতিত এই ভূমির জন্য সত্যিই এক বিশাল অর্জন।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সফলতার পরিচয় দিচ্ছে। একটা সময়, বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুহার ভারত এবং পাকিস্তানের থেকে বেশি ছিল, কিন্তু এখন কম। বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ গড় আয়ু একজন ভারতীয়র থেকে তিন বছর বেশি এবং একজন পাকিস্তানির থেকে পাঁচ বছর বেশি। বাংলাদেশের নারীদের অবস্থানও নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে: স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়ছে। চাকরিতে নিজেদের দক্ষতার সাক্ষর রাখছে। এই সময়ে মেয়েদের গর্ভধারণের প্রবণতাও কমে এসেছে— যদিও ১৭ কোটি মানুষ নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে দুটি ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে। তা হল— সাধারণ মানুষের নরমপন্থী মনোভাব এবং বাস্তবতার মুখোমুখি হবার সক্ষমতা। সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার জন্য ভারত এবং পাকিস্তানের নারীরা এখনও সর্বস্তরে ঘরের বাইরে কাজ করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে যা ছিল ৩%। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬%-এ। এরা হচ্ছে সেই নারীরা, যারা পোশাক শিল্পে অবদান রেখে দেশটির অর্থনীতিকে সামিনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের এই সৌভাগ্যের দ্বিতীয় কারণটি হল, ধারাবাহিকভাবে দেশটির ক্ষমতায় থাকা সরকারি দলের বহির্বিশ্বের সাহায্য গ্রহণে অসঙ্কোচ মনোভাব। এই মনোভাব প্রয়োজন থেকে তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সব রকম প্রশাসনিক কাঠামোকে এতোটাই দুর্বল করে দিয়েছিল, যে দেশটির পক্ষে সাহায্যের যেকোন হাত আঁকড়ে ধরা ছিল খুবই স্বাভাবিক, সে হাতটা যারই হোক। যদিও দাতব্য সংস্থা এবং এনজিও দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীবনের মান উন্নয়নে কাজ করেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী দূরাবস্থা কাটিয়ে ওঠার বেশ অনেক পর থেকে।
ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোও এদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা গ্রামের প্রান্তিক মানুষগুলোকে নিজের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা করেছে দারুণভাবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণের প্রত্যাশা এই মানুষগুলোর কাছে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্নের মতো। এনজিওগুলো প্রায় সবকিছুতেই সরকারের পাশাপাশি কাজ করেছে। কৃষকদের ফলন খারাপ হলে পাশে দাঁড়িয়েছে এনজিওগুলো আবার ফসল বিক্রির ক্ষেত্রেও বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত।
এক নজরে দেখে নেয়া যাক ৫০ বছরে আমাদের অর্জনের একাংশ—
- বিগত কয়েক বছরে জনগণের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৭২.৩ বছর।
- প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়ায় শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে।
- ২০১৯ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ২২,৫৬২ মেগাওয়াট, দেশের ৯৪ শতাংশ জনগণ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।
- ২০১৯ সালে আইসিটি খাতে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
- অন্যান্য রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
- রেমিট্যান্স আয় ১৬০০ কোটি মার্কিন ডলার।
- খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে অনেক আগেই। ২০১৯ সালে দেশের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি মেট্রিক টন।
- ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ।
- দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছ।
- ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ৩৬০ কোটি ডলার।
- গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজধানীতে ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রোরেল স্থাপন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা ১৬টি স্টেশনে ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রাখবে।
- বাঙালির স্বপ্নের সেতু পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে, যা নিজস্ব বাজেটেই সম্পন্ন হচ্ছে।
- বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে বঙ্গবন্ধু ১স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে।
- ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ।যেকোনো সময় জরুরি ভিত্তিতে সেবা পেতে আধুনিক বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চালু হয়েছে ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯কল সেবা।
বৃদ্ধি পাচ্ছে জাতীয় বাজেটের আকার
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার।
১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি, ২০১৮-২০১৯-এ ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি, ২০১৯-২০২০-এ ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি এবং ২০২০-২০২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭২২ গুণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১৮-২০১৯ সালে হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি, যা ৩৪৫ গুণ বেশি।
এসব কিছুর প্রতিফলন দেখা যায় বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ সড়কের ঘনত্ব, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের ৫০ বছরের অগ্রগতি স্বস্তিদায়ক। যেমন সার্বিক সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, গড় আয়ু, ইপিআই, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিতে অগ্রগতির উল্লেখ করা যেতে পারে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নই যেখানে মূল কথা নয়
তবে সরকারের তরফ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক উন্নয়নের যে দাবি করা হচ্ছে তা বহুলাংশে একতরফা। গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অনুপস্থিতি এবং ব্যাপক দুর্নীতির শোষণ তোষণ নিপীড়নের অভিযোগ নিয়েই মূলত স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র চর্চা ও সুশাসনের অভাব, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে সমালোচনাও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।
এছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বপরায়নতা এবং দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তারের মতোই প্রকট হয়ে উঠছে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের নানা দিক, বিশেষজ্ঞদের মতে ইতোমধ্যেই এগুলো প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে দেশের বিরাট অঞ্চলের মানুষের ওপর।
বাংলাদেশের এই অভাবনীয় ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা অথবা নেতৃত্বের দূরদর্শিতার কোন অবদান নেই। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই, এ দেশের রাজনীতি ছিল হিংসাত্মক এবং বিক্ষোভপূর্ণ। দুর্নীতি দেশটাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। বারবার অভ্যুত্থান ঘটেছে দেশটিতে, বারবার দমন পীড়নে শিকার হয়েছে বিপ্লবীরা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। তিনি মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ করেছেন। তার নিজের কর্তৃত্বে নিয়ে এসেছে প্রায় সমস্তকিছুই এবং পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে এমন সকল শক্তিকেই চূর্ণ করেছেন।
শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে করেছেন বিশাল আয়োজন। তথাপি সর্বক্ষেত্রে তার কর্তৃত্ববাদী মনোভাব ও সিদ্ধান্ত, দেশটির এই তড়িৎ উন্নয়নের মূল বৈশিষ্ট্যটাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মোহাম্মদ ইউনুস শান্তিতে নোবেল জয়ের পর রাজনীতিতে যোগ দিতে নতুন দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে তাকে গ্রামীন ব্যাংক থেকে বাদ দেয়া হয়। মোহাম্মদ ইউনুসের হাত ধরেই গ্রামীন ব্যাংক নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের সবথেকে বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য শেখ হাসিনা এমন এক ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়েছে যারা ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীদের অধিকার বিরোধী এবং বৈষম্যের পক্ষে। এই মৌলবাদী দল এবং সরকারি দলে ছাত্রসংগঠন মিলে সম্প্রতি তাদের এক নেতার বিরদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কটূক্তি করায় হিন্দু অধ্যুষিত এক গ্রামে বর্বর হামলা চালায়।
খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার
দেশের আর্থিক খাতের দুটি দুষ্ট খাত হলো খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার। এ দুটির মধ্যে আবার পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০–এর সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। তালিকার শীর্ষে থাকা ২৫ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩৫০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৪২ হাজার ২২১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের।
অর্থ পাচার রোধে দেশে শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন এ পাচার বন্ধ হচ্ছে না, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা জরুরি। বস্তুত, দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারের হারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
রাজস্ব খাতে আয়েও সরকারের দুর্বলতা সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি না হওয়ার বড় কারণ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের আয় গোপন করছেন। সরকারি হিসাবে দেশে কোটিপতি নাগরিকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হলেও কর প্রদানের সংখ্যা একশও নয়। দেশের এক বিরাটসংখ্যক জনগোষ্ঠী কর-জালের আওতায় নেই। তারা ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালোটাকা সাদা করে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এর জন্য দেশের দুর্নীতিবাজ কর প্রশাসন দায়ী।
এক বছরে ৩,৪৪০ জন নারী ও শিশু নির্যাতিত
বাংলাদেশের নারীরা আজ স্বাবলম্বী। জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম।
অথচ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ বছর জানুয়ারিতে করা এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনাকালে দেশে ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৪৪০ নারী ও কন্যাশিশু।
আগের বছর ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ও ৯৮৬ জন শিশু এবং ২০১৮ সালে ৭৩২ জন নারী ও ৪৪৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
সব ঘটনা সামনে না আসায় ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা এসব পরিসংখ্যানের চেয়ে আরও অনেক বেশিবলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মীরা।
প্রতি ২,৫০০ জনে একজন ডাক্তার
স্বাস্থ্য খাতে শিশুমৃত্যু এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমলেও স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিজন ডাক্তারের জন্য জনগণের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য সরবরাহ পর্যাপ্ত ও আধুনিক প্রযুক্তিগত নয়, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত নার্সও নেই।
ফলে সামর্থ্যবানেরা দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসা নেন এবং বাকিদের কপালে চিকিৎসাহীন মৃত্যুই শ্রেয়তর বলে বিবেচিত হয়।
উচ্চশিক্ষার বেহাল অবস্থা
স্বাধীনতার পর থেকে এখন অব্দি কোনো সরকারই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনমুখী মানসম্মত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবেননি। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এ+ গুণেই আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য নির্ধারণ করি। শিক্ষাব্যবস্থায় জিপিএর পরিমাণকে মানদণ্ড বিবেচনা করা নিরেট বোকামি ও জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে অভিমত দিচ্ছেন শিক্ষাবিদেরা।
আমাদের উচ্চশিক্ষার অবস্থা আরও বেহাল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রথম আটশবিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত ২০ বছরেও উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হয়নি, নেই কোনো সৃষ্টিশীলতা। এ ক্ষেত্রেও অসুস্থ রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। দলীয়করণের প্রভাবে যখন নিয়োগ, পদোন্নতি হয়, তখন প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন করার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
আংশিক গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশ
ফ্রিডম হাউস নামক যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থা প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অধিকার (১০টি প্রধান চলক) ও সিভিল রাইট (১৫টি প্রধান চলক) নিয়ে দেশ ও অঞ্চল ভিত্তিতে ১০০ নম্বরের একটি কমপোজিট সূচকের স্কেলের মাধ্যমে গণতন্ত্রের একটি পরিমাপক তৈরি করে থাকে।
২০১৯-এ ২১২টি দেশ ও অঞ্চলের ওপর যে জরিপ পরিচালিত হয়, তাকে একটি স্কেলের তিনটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি দেশের অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। এ তিনটি ভাগ হচ্ছে, ১. মুক্ত, ২. আংশিক মুক্ত, ৩. মুক্ত নয় এ রকম দেশ। বাংলাদেশ ১০০ নম্বরের মধ্যে ৩৯ নম্বর পেয়ে আংশিক মুক্তদেশের কাতারভুক্ত রয়েছে।
৬৫ নম্বরের কম পাওয়া মানে আংশিক মুক্তএবং ৩০-এর কম হলে মুক্ত নয়দেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৯ সালের বিশ্লেষণে বিশ্বব্যাপী ২১২ দেশের মধ্যে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ, ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ ও ২৫ দশমিক ১ শতাংশ দেশ যথাক্রমে মুক্ত, আংশিক মুক্ত ও মুক্ত নয় দেশ— তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে ভারত ৭১, ভুটান ৫৮, নেপাল ৫৬, শ্রীলঙ্কা ৫৫, বাংলাদেশ ৩৯, পাকিস্তান ৩৮ ও মিয়ানমার ৩০ স্কোর পেয়েছে। এখানে ভারত ছাড়া সবাই-ই আংশিক মুক্ত দেশের তালিকাভুক্ত।
দূর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান
টিআই প্রণীত দুর্নীতির ধারণা সূচকে আমরা গত ২০ বছরের তুলনায় ভালো করেছি বলা যায়। একসময় দুর্নীতিগ্রস্ততায় পরপর চারবার ১ নম্বরে (২০০১-২০০৪) থাকার পর যেহেতু দেশের সংখ্যা বেড়েছে, তাই স্কোরের বড় উন্নয়ন না করেও আমাদের অবস্থান ওপরে উঠে আসে।
২০২০-এর প্রতিবেদনে ১৮০ দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৪ তম। তবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আটটি দেশের মধ্যে আমরা শুধু আফগানিস্তানের ওপরে আছি।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সর্বসাম্প্রতিক কালের গ্লোবাল কমপিটিভনেস ইনডেক্সও আমাদের অবস্থানের অবনতি ঘটেছে, ১৪১টি দেশের মধ্যে ১০৫-এ নেমে এসেছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার পর আমাদের অবস্থান।
পদ্মা ব্রিজ, রূপপুর পারমাণবিক প্ল্যান্ট, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, উড়ালসেতু প্রভৃতি বড় বড় কাঠামোর কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বজায় থাকলেও শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সূচকগুলোতে আমাদের অবস্থান সম্মানজনক বলা যায় না।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য
সরকারি ভাবে বলা হচ্ছে এসব খাতেই এমন অগ্রগতি হবে যে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ।
ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে ধারণা দিয়ে বলেছে বাংলাদেশ এখন যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।
কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা ও জীবন মানের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বরাবরই উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক সামাজিক বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলছেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে বাংলাদেশকে।
তিনি বলেন, কিভাবে বৈষম্য দুর করা যায়, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দুর করা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা যায়- এসব বিষয় বাংলাদেশের সামনে আগামী দিনগুলোতে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ যে গতিময়তার সাথে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে তার সুফল সবাইকে দিতে হলে সেই প্রবৃদ্ধি হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। একই সাথে সামাজিক সাম্যতার পাশাপাশি প্রয়োজন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী অবশ্য বলছেন, গণতন্ত্রের সুফল ও অর্থনৈতিক সমতা কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থার জের ধরে তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের সামনে।
তিনি বলেন, ভূ -কৌশলগত অবস্থানের কারণে অনেক সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সেটি দেখা যাচ্ছে। এ গুরুত্বের জায়গা কিভাবে ডিল করা হবে সেটিও সামনে আসবে। ভূমিকম্প বা বজ্রপাত বেড়ে যাচ্ছে-এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই। আর যে সোনার বাংলা মিথ নিয়ে বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা করেছি তার মূলে ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র তৈরি করা।
তিনি বলেন, ধর্ম, মত ও আদর্শিক সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করাটাও হবে বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়।
গত ৫০ বছর বাংলাদেশকে উদযাপনের অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রে যে রাজনৈতিক পথ পেয়েছিলেন, সেই পথে এখন তিনি আর হাঁটছেন না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ