আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের দিন। দীর্ঘ নয় মাস বিভীষিকাময় সময়ের পরিসমাপ্তির দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন।
১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাক হানাদার বাহিনী।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার দিন আজ। মহান বিজয়ের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাঙালির স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
আজ বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১- এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও দু’লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব-মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম হানাদার মুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ আর তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও গৌরবগাঁথা গণবীরত্বে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাপধীনতা লাভ করলেও ভ্রান্ত দ্বিজাতির তত্ত্বের ভিত্তিতে যে অসম পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয় বাঙালি জাতিকে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকে বাঙালি জাতির ওপর শুরু হয় বৈষম্য, শোষণ, অত্যাচার নির্যাতন। পাকিস্তানের এই শোষণ বঞ্জনা আর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি সোচ্চার হতে থাকে এবং ধাপে ধাপে পাকিস্তানের অত্যাচরের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। বাঙালির এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে নেতৃত্বে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির এই আন্দোলনকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত করেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের হত্যা যজ্ঞে মেতে উঠলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে সর্বস্তরের বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের পাশে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে এগিয়ে আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত। সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং কোটি বাঙালিকে আশ্রয় দিয়ে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িযে দেয়। ওই সময় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন দিয়ে সরাসরি পক্ষ্য নেয়।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী
যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
১৬ই ডিসেম্বর বীর বাঙালির বিজয় দিবস। এ বছর দিনটিতে বাঙালি জাতি বিজয়ের ৫০ বছর পূর্ণ করছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে যথাযথ মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর ও জাকজমকপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে।
৫০ বছরে এসে কেমন আছে বাংলাদেশ?
স্বাধীনতার পর তাচ্ছিল্য করে অনেকে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি কিংবা টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট বলে অভিহিত করেছিল। আজ সারা বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
গত দুই দশকে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে সাত শতাংশ এবং করোনাকালে পাশ্চাত্যের বহুদেশে যখন ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেক্ষেত্রেও বাংলাদেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা পাঁচভাগ অতিক্রম করেছে।
অধিকাংশ দেশে জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধি ঘটলেও সামাজিক সূচকে তার প্রতিফলন ঘটে না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সামাজিক সূচক সমূহে ইতিবাচক অগ্রগতি দৃশ্যমান। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হারের বিশাল উন্নতি হয়েছে, ছয় কোটি ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা লাভ করছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি।
তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। ধন বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা অর্জিত হয়নি, ঋণখেলাপিদের সংখ্যা ও পরিমাণ বেড়েছে, বারবার দাবি করা সত্ত্বেও ব্যাংকিং কমিশন গড়ে উঠেনি।
বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের যথাযথ তালিকার বিষয়ে বিচারালয়ের তাগাদা সত্ত্বেও গড়িমসি চলছে। দেশের সর্বত্র ক্ষমতাবানদের লোভের সংক্রমণ সমাজে অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সামাজিক অবক্ষয়। বহুক্ষেত্রে দুর্নীতি ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই দৃশ্যমান।
সর্বোপরি, ত্রিশ লক্ষ মানুষ যে ধারার রাষ্ট্র গঠনের জন্য আত্মদান করেছে, যার ভিত্তিতে বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চারনীতি প্রণীত হয়েছিল, সেটি আক্রান্ত হয়েছে।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর এই নীতিসমূহ সংশোধিত হয়েছিল, দেশকে পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় পরিচালনার পরিকল্পিত প্রয়াস চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানে এই নীতিসমূহ প্রতিস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে, ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যায় বহুজন আচ্ছন্ন হয়েছে, আমরা কতটা মুসলমান আর কতটা বাঙালি এ দ্বিধা আজও গেল না। বস্তুতপক্ষে সমাজে এই নীতিসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার ফলে সরকার প্রায়শ সমঝোতার পথ গ্রহণ করে, আর তার বিস্তার লক্ষ্য করা যায় তৃণমূল পর্যায়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সুশাসনের ক্ষেত্রে। আমরা কেন যেন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠী ও দলপ্রীতির বাইরে যেতে পারি না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ক্ষমতার রাজনীতি করে, তারা ক্ষমতার বাইরে থাকতে যেসব কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে তার উল্টোটা চর্চা করে। এটা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি অতীতে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির বেলায়ও সত্য। এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।
রাজনীতি আর গণতন্ত্র কতদূর এগিয়েছে?
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে। আর টক অব দ্য টেবিলে বাংলাদেশের নামটা উঠে আসছে বেশ জোরেশোরেই। গণতান্ত্রিকভাবে স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিপালনে রোল মডেল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। আর চালকের আসনে আছে আওয়ামী লীগ।
বলে রাখা ভালো, প্রায় ৩ বছর আগেই বাংলাদেশ বিশ্বের নতুন একনায়কতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসমান স্টিফটুং তাদের গবেষণা থেকে এমনটি জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০টি দেশের সরকার দুই বছর ধরে আইনের শাসনকে ‘বন্দী’ করে রেখেছে। অন্যদিকে ৫০টি দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। সারা বিশ্বেই গণতন্ত্র এখন চাপের মুখে রয়েছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশের রাজনীতি আর গণতন্ত্র কতদূর এগিয়েছে? যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাঙ্খিত লক্ষ্য থেকে এখনও আমরা বহুদূরে!
কেউ কেউ তো বলছেন, আমরা উল্টোপথে চলছি৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আমরা বহুদূর সরে গেছি৷
আমাদের এখানে গণতন্ত্রের ধারণাই হারিয়ে গেছে৷ অর্থনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে সত্যি৷ কিন্তু এখন যারা নির্বাচিত হচ্ছেন তারা তো রাজনীতিকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছেন, কাজ করছেন অর্থ উপার্জনের মানসিকতা নিয়ে৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের এখানে গণতন্ত্রের ধারণাই হারিয়ে গেছে৷ অর্থনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে সত্যি৷ কিন্তু এখন যারা নির্বাচিত হচ্ছেন তারা তো রাজনীতিকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছেন, কাজ করছেন অর্থ উপার্জনের মানসিকতা নিয়ে৷ কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে৷ ১৯৮০ এর দশক থেকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি গণতন্ত্রকে নির্বাচনতন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে৷ এটাকে কী গণতন্ত্র বলা যায়? গণতন্ত্র একটা আদর্শ, যা একটু একটু করে বিকশিত হবে৷ আমাদের গণতন্ত্রের ধারণা সীমাবদ্ধ হয়েছে নিতান্ত নির্বাচনের মধ্যে৷ আর নির্বাচন যেটা হচ্ছে, সেটা গ্রহণযোগ্য না৷ আমরা ধারণা করেছিলাম, আস্তে আস্তে আমরা গণতন্ত্রের দিকে যাব৷ কিন্তু গণতন্ত্র এখান থেকে হারিয়ে গেছে৷ অনেকে সমাজতন্ত্রের চিন্তা করতেন, সেটাও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর হারিয়ে গেছে৷ তবে আমরা আশা করি, অবস্থা এমন থাকবে না, পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷ এখন একটা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা৷ যে মানুষ বঞ্চনার শিকার সে এক সময় অবশ্যই প্রতিবাদে এগিয়ে আসবে’৷
এই ৫০ বছরে রাজনীতি আর গণতন্ত্র কতটা মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়েছে? জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে এবং তার মাধ্যমে যে অর্জন করেছিলাম তার প্রায় সবটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে৷ মুক্তিযুদ্ধের উল্টো পথে দেশ চলছে৷ আমাদের লক্ষ্য ছিল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা৷ জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা বুঝতাম সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীন অবস্থান৷ এখন আমরা আমেরিকাসহ আধিপত্যবাদী রাজনীতির কাছে নতজানু৷ সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য থেকে আমরা অনেকদূর৷ এখন লুটপাটতন্ত্র চালু হয়েছে৷ মানুষের মধ্যে বৈষম্য বহুগুণ বেড়ে গেছে৷ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিত্ত সংগ্রহের একটা পথ তৈরি হয়েছে৷ মুষ্টিমেয় লোক রাতারাতি অবাধ সম্পদের মালিক হওয়ার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে দখল করে রেখেছে৷
তাদের দুইটা গ্রুপ একটা আওয়ামী লীগ আরেকটা বিএনপি৷ তাদের ভেতরে দ্বন্দ্ব হল লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে৷ এখন ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৪১ কিন্তু ভিশন ১৯৭১টা কোথায় গেল? এ প্রশ্নের তো তারা উত্তর দেয় না৷ গণতন্ত্র তো বটেই, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করা হয়েছে৷ ভোটাধিকারকে ধ্বংস করা হয়েছে৷ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে গাট্টিবোচকা নিয়ে বিদেশে চলে যেতে হবে এটা তো ক্ষমতাসীন দলের সেক্রেটারি নিজেই বলেছেন৷ বিএনপিও একই পলিসি চালিয়েছে৷ তারাও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে৷ এগুলোর সঙ্গে তো মুক্তিযুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই, বরং বিপরীতমুখি অবস্থান’৷
রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে হত্যা বাড়ছে
বাংলাদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে হত্যা বাড়ছে। বাড়ছে হানাহানি। আর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো মূলত ঘটছে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে। নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্বের কারণেও ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ঘটছে গুপ্ত হত্যা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই ১০ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৭৪জন। এরমধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় মারা গেছেন ৪৩ জন। এরমধ্যে ইউপি নির্বাচনে ৩১ জন। পৌর নির্বাচনে ১০ জন এবং সংসদীয় উপনির্বাচনে সহিংসতায় মারা গেছেন তিন জন।
অবশ্য এর আগের বছর ২০২০ সালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অনেক কম ছিলো। ওই বছর পুরো ১২ মাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩১টি। তার মধ্যে নির্বাচনী সংঘাতে মারা গেছে পাঁচ জন। গত বছর অল্প কিছু নির্বাচন ও উপনির্বাচন ছিলে। এরমধ্যে উপজেলা নির্বাচনে একজন এবং পৌর ও সিটি নির্বাচনে চার জন নিহত হন।
২০১৯ সালে রাজনৈতি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৯টি। তার মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনে নিহত হয়েছেন ২৫ জন। ২০১৮ সাল ছিলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। ওই বছর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৯টি। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হয়েছে ৫২টি।
আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১৭ সাল থেকে এপর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যা চলতি বছরেই বেশি ঘটেছে। নির্বাচনি খুনও বেশি। আর ১০ মাসেই তা আগের বছরের দুই গুণেরও বেশি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডও এই ১০ মাসেই বেশি।
চলতি বছরে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পেছনে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা। আর এই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের হাতেই আওয়ামী লীগের লোকজন বেশি খুন হয়েছে। বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচনে নাই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশ ঘটে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দুই ধাপের ইউপি নির্বাচনে এপর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪৭ জন।
তবে আগে যেটা হতো, যে জনপ্রিয় সেই পাস করত। কিন্তু এবার জনপ্রিয়তার সাথে প্রতীক যুক্ত হয়েছ। বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে নেই দলীয়ভাবে তাই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। প্রার্থীরা মনে করছেন নৌকা প্রতীক পেলে জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যারা পাচ্ছেন না তারা বিদ্রোহী হচ্ছেন। ফলে সংঘাত ও হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। এটা কমাতে প্রতীকের বিষয়টি ফের বিবেচনা করা উচিত।
বিশ্লেষকরা বলেন, স্বাধীনতা যেকোনো জাতির জন্য গৌরবের, অহংকারের। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৫০ বছর পর দেখা যাচ্ছে আমাদের কারো কারো মধ্যে স্বাধীনতা নিয়ে উচ্ছ্বাস নেই, কারো মধ্যে বা কিছুটা বিরূপতাও তৈরি হয়েছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশ এখন উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামসহ কিছু ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে দেশকে এতটাই পিছিয়ে নিয়েছে যে, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলেও নাকি এতটা পশ্চাৎধাবন হতো না।
একটি ধর্মনিরপেক্ষ, ন্যায়ানুগ, সাম্যময় মুক্ত দেশ চাই। একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এক পাকিস্তান ভেঙে দুই পাকিস্তান বানানোর জন্য নয়। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের জায়গায় বাংলাদেশে ২২শ পরিবারের হাতে দেশের সব সম্পদ কুক্ষিগত হবে— এটাও আমাদের প্রত্যাশিত ছিল না। আজ বাংলাদেশে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন তার মোকাবিলায় কেবল আওয়ামী লীগের কাছে চাওয়ার তালিকা না বাড়িয়ে আমরা আমাদের যার যার অবস্থানে থেকে কি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারি না? হেফাজত বা অন্য শক্তিগুলো যদি পশ্চাৎপদ ধারায় জনমত গঠন করতে পারে তাহলে যারা নিজেদের আধুনিক, গ্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করেন তারা কেন এই চিন্তাচেতনায় মানুষকে বোঝাতে পারেন না, সংগঠিত ও সমবেত করতে পারেন না? মানুষ নিশ্চয়ই বৈষম্য ও অন্যায্য ব্যবস্থায় বাস করতে চান না!
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/৪৫৩
আপনার মতামত জানানঃ