ডঃ মঞ্জুরে খোদা : বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল মাদ্রাসা শিক্ষাকে সমর্থন করে! কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাকে সমর্থন করার কারণ প্রধানত ধর্মীয়, ব্যক্তি-পরিবারের ইচ্ছা ও আর্থিক! কারণগুলো আপাত দৃষ্টিতে অতি নিরীহ। নাগরিকদের সেই অংশই আবার হেফাজতের অতি ধর্মীয় রক্ষণলীলতার কারণে সংগঠনটির এবং তাদের কর্মকান্ডের ঘোর বিরোধী! সেক্ষেত্রে তাদের ক্ষোভ-ঘৃণা-ভীতি হচ্ছে হেফাজতের কথা শুনলে-মানলে তাদের জীবন-যাপন নানা ভাবে নিয়ন্ত্রিহ হবে, ক্ষতিগ্রস্থ হবে, অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে! সেটা তারা কোনভাবেই চান না, মানবেন না! হেফাজতের শীর্ষনেতারা নারী স্বাধীনতা, আধুনিকতা, তারুণ্য, শিক্ষা, বাঙালি সংস্কৃতি, সমাজ ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সময় যে বক্তব্য রেখেছেন, সে কারণে তাদের মধ্যে এই ঘৃণা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না, হেফাজত নেতাদের এই বক্তব্য কওমী মাদ্রাসার মূল বক্তব্য ও অভিন্ন আদর্শ! তাহলে কওমী ও হেফাজতের একটিকে পছন্দ, অন্যটি অপছন্দ, অথবা একটিকে সমর্থন, অন্যটির বিরোধীতা বিষয়টি অদ্ভুদ স্ববিরোধীতা হয়ে যায় না? আপনি যদি মাদ্রাসার সমর্থক হোন তাহলে আপনি হেফাজতেরও সমর্থক! আর যদি আপনি হেফাজতের বিরোধী হোন, তাহলে আপনাকে মাদ্রাসারও বিরোধী হতে হবে! কারণ, হেফাজত ও কওমীর কারণ-সমীকরণ অভিন্ন, তাকে আপনি আলাদা করতে পারবেন না, সম্ভব না! এতদিন আপনি বুঝতে পারেন নি, এই শিশু ঘুমন্ত ভাল্লুককে! কিন্তু আপনাদের নির্লিপ্ততা ও অগোচরে আজ তা এক বিশাল দৈত্যে পরিণত হয়েছে! তবু কি এই প্রশ্নে আপনাদের ভ্রান্তি কাটছে, ঘুম ভাঙ্গছে?
হেফাজত কি?
হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ হচ্ছে কওমী মাদ্রাসভিত্তিক একটি সংগঠন। ১৯ জানুয়ারী ২০১০ চট্রগ্রামের প্রায় ১০০ কওমী মাদ্রাসার শিক্ষকদের নিয়ে এই সংগঠনটি তৈরী হয়। মূলত ২০০৯ ও ১০ সালে নারীনীতি ও একমূখী শিক্ষানীতির বিরোধীতার মধ্যেদিয়ে এ সংগঠনের জন্ম হয়। বর্তমানে এ সংগঠনের চেয়ারম্যান, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাবোর্ডেরও চেয়ারম্যান মাওলানা আহমেদ শফী, এবং আল জামিয়াতুল দারুল উলুম মাদ্রাসার পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরী এর মহাসচিব। সুতরাং হেফাজত ইসলাম শতভাগ কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন এটা নিয়ে দ্বিধা থাকার কোন অবকাশ নেই!
হেফাজত কি চায়?
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম ঢাকার শাপলা চত্তরে ধর্মের অবমাননা ও নাস্তিকতার অভিযোগে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধীতা করে এক বিশাল সমাবেশ করে। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারের কাছে ইসলামের হেফাজতে ১৩ দফা দাবী পেশ করে! এবং বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ (!) আওয়ামী লীগ সরকার তাদের দাবিগুলো সহানুভূতির সাথে বিবেচনায় নিয়ে পর্যায়ক্রমে ও কৌশলে বাস্তবায়নের কথা বলে!
হেফাজতের দাবী সমুহঃ
১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।
২. আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩. কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
৯. রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।
১২. সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
স্ববিরোধীতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে
বাঙালির স্ববিরোধীতার শেষ নেই। বলবেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে কোন পার্থক্য নেই! দুই নেত্রীর স্বভাব-চরিত্র এক! কিন্তু ভোটের বেলায় এ দুয়ের যে কোন একটিকে বেছে নেবেন! মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নিজেকে উদার মনে করবেন, আবার তাদের অভিভাবক সংগঠন হেফাজত ইসলামকে ঘৃণা করবেন! আইনের শাসন চায়, আবার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে! গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং নিজের পছন্দের দল সবসময় ক্ষমতায় থাকবে সেটা চায়! ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চায়, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরোধীতা করবে না! সংবিধানে আছে একমূখী শিক্ষা, কিন্তু বাজারে আছে বার ধারার শিক্ষা! নির্বাচনে সৎ-যোগ্য-ভাল পক্ষে বলে, কিন্তু ভোটের বেলায় মার্কা খুঁজে! চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, কিন্তু কাজকর্ম সাম্প্রদায়িক! মুখে ঐক্য-সংহতি বাস্তবে কর্তৃত্ব ও একনায়কত্বের পুজারী!
স্ববিরোধীতার এই বিপদজনক সংস্কৃতি আমাদের সমাজ ও রাজনীতির ভয়ঙ্কর সংকট তৈরী করছে! যে কারণে গড়ে উঠতে পারছে না একটি সুস্থ ধারার রাজনীতি, সংগঠন ও আন্দোলন। তাহলে কি আমাদের ভবিষ্যত ছেড়ে দিতে হবে নিয়তি ও শাসকের ইচ্ছার উপর? সেই প্রশ্ন ও আত্মপলব্ধি হতে পারে স্ববিরোধীতার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসার পথ।
ডঃ মঞ্জুরে খোদা, লেখক, গবেষক ও এক্টিভিস্ট।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ