
কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞান একটিমাত্র কোষ থেকে সম্পূর্ণ মানবদেহ গঠনের রহস্য জানার চেষ্টা করে আসছেন। তারা জীনগত রোগ, গর্ভপাত এবং বন্ধ্যাত্বের কারণ জানার চেষ্টাও করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
এবার পরীক্ষাগারে মানবভ্রূণের আদিদশা তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন কৃত্রিম ‘এমব্রায়ো’ বা ভ্রূণ ‘ব্লাস্টয়েড’। এই ব্লাস্টয়েড থেকেই মানবশরীর, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হবে। মূলত দুইটি নতুন পরীক্ষার মাধ্যমে তারা এখন অব্দি সবচেয়ে পরিপূর্ণ ‘মডেল ভ্রূণ’ তৈরি করতে পেরেছে।
এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল মানবভ্রণের আদিদশার ক্রমবিকাশ জানা এবং একই সাথে শিশুর জন্মগত ত্রুটি, অপরিকল্পিত গর্ভপাত এবং বন্ধ্যাত্বের কারণ জেনে তা প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা।
ব্ল্যাক বক্স
ভ্রূণের ক্রমবিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা কাটে গর্ভধারণকালীন মায়ের শরীরেই এবং সেজন্যই এটা নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব ছিল না একপ্রকার। পাশাপাশি পরীক্ষাগারে মানবভ্রূণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বেশ কঠিন এবং বিতর্কমূলক।
আমরা প্রাণীদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। ইঁদুর নিয়ে অনেক গবেষণাই করা হয়েছে। তবে মানুষকে নিয়ে তেমন একটা গবেষণা হয়নি, ডালাসে অবস্থিত টেক্সাস সাউথওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের আণবিক বায়োলজিস্ট জুন উং বলেন। জুন উং মানবভ্রূণের উপর পরিচালিত দু’টো গবেষণার একটির নেতৃত্ব দেন। তিনি এই গবেষণা কে ‘ব্ল্যাক বক্স’ বলে অভিহিত করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে এমন ধরণে কাঠামো তৈরির চেষ্টা করেছেন যেটা কিনা হিউম্যান এমব্রায়োর অনুরূপ। এজন্য তারা কোয়াক্স সেলগুলোতে রাসায়নিক সিগনালকে অস্তিত্বশীল করে তুলেছে যা দেখতে মানবভ্রূণের আদিদশার মতো।
এখন উংয়ের দল এবং বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল, এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যা আগে কখনও সম্ভব হয়নি। তার মানবভ্রূণের আদিদশা সদৃশ কোষ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা কিনা গর্ভে ইমপ্ল্যান্ট করা হয় সাধারণত। যাকে বলা হচ্ছে ভ্রূণ ‘ব্লাস্টয়েড’। এই ব্লাস্টয়েড থেকেই মানবশরীর, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হবে।
আমরা খুবই উত্তেজিত, অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির বায়োলজিস্ট জোস পোলো বলেন। জোস পোলও দ্বিতীয় গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন এখন এই কৌশলে আমরা অজস্র এমব্রায়ো তৈরি করতে পারবো। যা কিনা আমাদের মানবভ্রূণের আদিদশা নিয়ে বিস্তারিত জানতে সাহায্য করবে। আমরা মনে করি এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কী ছিল গবেষণায়?
বিজ্ঞানীরা দুইভাবে এই পরীক্ষা করেছেন। প্রথমত, মানুষের ত্বকের কোষ নিয়ে তার মধ্যে জিনের গঠনবিন্যাস নতুন করে সাজিয়েছেন। মানে জেনেটিক্যালি রিপ্রগ্রাম করে সেই কোষকে ভ্রূণের প্রাথমিক চেহারা দেওয়া হয়েছে। ভ্রূণ ঠিক যেমন আকৃতির, সেই গোলাকার রূপ দিয়েছেন গবেষকরা। আর এই কোষ দেখতে হয়েছে অবিকল মানুষের ভ্রূণের কোষ ব্লাস্টোসিস্টের মতো।
দ্বিতীয় গবেষণায় বিজ্ঞানীরা মানুষের স্টেম কোষ (Stem Cell) নিয়ে একইরকম গবেষণা করে ব্লাস্টোসিস্ট তৈরি করেছে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ভ্রূণ তৈরির আদিদশাকে বলে ব্লাস্টোসিস্ট। শুক্রাণু-ডিম্বাণুর মিলন হওয়ার পাঁচ দিন পরে যে কোষ প্রাথমিকভাবে তৈরি হয়, তাকেই ব্লাস্টোসিস্ট বলে। প্রথম পর্যায়ে ১৬টি কোষ নিয়ে গোলাকার বলের মতো গঠন তৈরি হয়। এর পরিধি হয় ০.১-০.২ মিলিমিটার। ধীরে ধীরে এই গোলাকার বলটা বড় হতে থাকে। ২০০ থেকে ৩০০ কোষ থাকে।
এই কোষগুলোর আবার বিভাজন শুরু হয়। এরপর ব্লাস্টোসিস্ট জরায়ুর মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট হয় এবং ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণের চেহারা নিতে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা এই ব্লাস্টোসিস্টই তৈরি করে ফেলেছেন।
গবেষকরা বলছেন, কৃত্রিমভাবে তৈরি ব্লাস্টোসিস্টের মধ্যে এমন কোষও ঢোকানো হয়েছে, যার থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হতে পারে। শুক্রাণু-ডিম্বাণুর নিষেকে তৈরি সাড়ে তিন দিন বয়সী একটি স্বাভাবিক ভ্রূণ থাকলে মাতৃজঠরে যা যা পরিবর্তন ঘটার কথা, এ ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটতে পারে।
অর্থাৎ এই পরীক্ষা যদি শেষ পর্যন্ত সফল হয়, তাহলে গবেষণাগারেই কৃত্রিমভাবে প্রথম মানবশিশু তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে সেই পর্যন্ত গবেষণা এগোতে এখনও অনেক সময় লাগবে।
অর্থাৎ এই পরীক্ষা যদি শেষ পর্যন্ত সফল হয়, তাহলে গবেষণাগারেই কৃত্রিমভাবে প্রথম মানবশিশু তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে সেই পর্যন্ত গবেষণা এগোতে এখনও অনেক সময় লাগবে।
‘যদিও কৃত্রিমভাবে তৈরি এই ব্লাস্টয়েডের সাথে প্রাকৃতিক ভাবে গঠিত এমব্রায়োর যথেষ্ট পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের কারণে হয়তো পরীক্ষাগারে তৈরি ব্লাস্টয়েড দিয়ে কখনওই স্থিতিশীল ফেটাস বা মানবশিশু অব্দি হয়তো পৌঁছানো যাবে না। তবে এটা খুবই কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে।’ মিশিগান ইউনিভার্সিটির মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক জায়ানপিং ফু বলেন, আমি এটাকে এই ক্ষেত্রের অন্যতম প্রধান অর্জন বলে মনে করছি। এটি প্রকৃত অর্থেই হিউম্যান এমব্রায়োর প্রথম পরিপূর্ণ মডেল।
এখানে একটি প্রশ্ন উঠে আসতে দেখা যায়। কোন অবস্থায় বা কীভাবে এই এমব্রায়ো মডেল প্রকৃত এমব্রায়ো হয়ে উঠবে, কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বায়োথিসিস্ট ইনসো হুয়ান বলেন।
দু’টো পরীক্ষা আলাদা কোষ দিয়ে করা হয়েছিল। যদিও গন্তব্য ছিল একই। উংয়ের দলটি মানুষের ভ্রূণাবস্থিত স্টেম কোষ ব্যবহার করেন। পোলোর দলটি ত্বকের কোষ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
এমনকি ইসরায়েলের ওয়েজম্যান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা গর্ভের বাইরে ইঁদুরে এমব্রায়ো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে— যা কিনা ‘কৃত্রিম গর্ভ’ তৈরিতে আরও একধাপ এগিয়ে নিল। ন্যাচারে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবন্ধকতা
শুক্রাণু নেই, ডিম্বাণুও নেই। নিষেকও হয়নি। তা-ও জন্ম নিয়েছে মানবভ্রূণ। চিন্তা-ভাবনারও যা বাইরে, তা-ই করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। যে কোষ মায়ের গর্ভে বেড়ে মানবশিশুর চেহারা নেবে, তারই প্রাথমিক রূপটা তৈরি করে ফেলেছেন গবেষকরা।
স্ত্রী ও পুরুষের শরীর থেকে নেওয়া ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ছাড়াই কৃত্রিমভাবে মানুষের ভ্রূণ তৈরি করার চেষ্টা চলছিল বহু বছর ধরেই। নানা রকম গবেষণা হয়েছে।
কিন্তু বারবারই ব্যর্থতা এসেছে। সেই সঙ্গে নীতিগতভাবে নানা নিয়ম-কানুনের বাধাও টপকাতে হয়েছে। একই মানুষের প্রতিরূপ বা হিউম্যান ক্লোনিং নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক, আইনি ঝামেলা, প্রতিবাদ-আন্দোলন সবই হয়েছে। এই গবেষণার ওপর নিষেধাজ্ঞাও চাপানো হয়েছে। একই রকম সমস্যা ছিল কৃত্রিমভাবে মানবভ্রূণ তৈরির গবেষণা নিয়েও।
গত বুধবার ‘ন্যাচার সায়েন্সে’ নামক জার্নালে এই গবেষণার উপর দু’টো আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সেখানেও এই গবেষণাকে নৈতিকতার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির বায়োথিসিস্ট ডা. ড্যানিয়েল সালমাসি বলেন, আমি নিশ্চিত যারা নৈতিকতার দিক দিয়ে মানুষের পক্ষে বিজ্ঞানের এই অর্জনের খুশি হওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। যেখানে মানবভ্রণের আদি অবস্থা আমরা পরীক্ষাগারে তৈরি করতে পেরেছি।
তারা এটা মেনে নেয়ার অবস্থায় এখনও পৌঁছাননি। যত বেশি ভাবতে চাইবে, নৈতিক দিক দিয়ে তারা সংকটে পড়বে আরও বেশি। আমার মনে হয় তআরা মনে করছে এটা টেস্টটিউবে মানুষ তৈরি করে ফেলার মতো ব্যাপার, সালমাসি বলেন।
এই গবেষণা মানুষের দীর্ঘদিনের ধারণাকে নাড়িয়ে দেবে। জীবন কী, কীভাবে শুরু, এই নিয়ে আমাদের বদ্ধমূল ধারণা গোড়া থেকে তুলে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। একে আমি বলবো বায়োলজিকাল-মেটাফিজিকাল টাইম মেশিন, হুয়ান বলেন
হুয়ান মনে করেন, এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এ থেকে আমরা অনেককিছু অর্জন করতে পারবো। তবে এটা নিয়ে সুস্পষ্টতা দরকার যে বিজ্ঞানীরাসহ জড়িত সবাই কীভাবে এই ধরণের একটি গবেষণা পরিচালনা করেছি।
এজন্য হুয়ান ‘১৪-দিনের নিয়ম’ নামের একটি গাইডলাইন অনুসরণ করতে চান। যেখানে উল্লেখ আছে, দুই সপ্তাহের কম বয়সী হিউম্যান এমব্রায়ো নিয়ে পরীক্ষাগারে কোন প্রকার গবেষণা করা যাবে না। যদিও হুয়ান মনে করেন, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নিয়মের লঙ্গন করা যায়, যদি তা বৃহত্তর স্বার্থে হয়ে থাকে।
ক্রিস্টিয়ান ম্যাথুস, রাইস ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ও টেকনোলজি পলিসির এক কর্মী বলেন, এর মানে এই দাঁড়ায় আমরা একের পর এক টেস্ট টিউবে এভাবে মানবভ্রূণ তৈরি করবো, তাই তো? আমার মনে হয় আমি খুব বেশি সাই ফাই দেখে ফেলেছি, আমার কাছে এটি বিরক্তিকর লাগছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫২৭
আপনার মতামত জানানঃ