যতোই দিন যাচ্ছে উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতনের অভিযোগে বিশ্বব্যাপী তোপ বাড়ছে চীনের ওপর। শিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লংঘনের জন্য বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ঘোষণা করেছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এক সমন্বিত প্রয়াসের অংশ হিসেবে এ নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করা হয়। এদিকে পিছিয়ে নেই চীনও। এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছে বেইজিং। তারাও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইইউ’র ১০ ব্যক্তি ও চার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। উইঘুরদের উপর নির্যাতনের কারণে চীনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে প্রতিশোধমূলক এই পদক্ষেপ নিল বেইজিং৷ খবর এএফপি, এপি, রয়টার্স।
উইঘুরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে বরাবরই সরব যুক্তরাষ্ট্র। তবে তাদের মিত্র ইইউ এ বিষয়ে অনেকটাই নীরব। বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য তাদের কখনোই খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি।
তবে সোমবার চীনের এক শীর্ষ নিরাপত্তা পরিচালকসহ চার কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন শিনজিয়াংয়ের জননিরাপত্তা ব্যুরোর পরিচালক চেন মিংগুয়ো।
ইইউর অভিযোগ, চেন ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’-এর জন্য দায়ী।
ইইউ জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সোমবার চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হন। এর মধ্য দিয়ে গত ৩০ বছরের বেশি সময় পর আবারও ইইউ’র নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে যাচ্ছে চীন।
ইইউর অফিসিয়াল জার্নালে বলা হয়েছে, উইঘুরসহ অন্য মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘুদের বেআইনিভাবে বন্দি করা এবং তাদের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা নিয়মতান্ত্রিকভাবে লঙ্ঘনে জড়িত চেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ নির্দেশনায় পড়া বাকিরা হচ্ছেন চীনের জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা ওয়াং মিংশান এবং ওয়াং জুনশেন, শিনজিয়াংয়ের সাবেক ডেপুটি পার্টি সেক্রেটারি ঝু হাইলুন, শিনজিয়াং প্রোডাকশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কর্পস (এক্সপিসিসি)।
এদিকে, চীনের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য।
দেশগুলো বলেছে, শিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে একটি পরিষ্কার বার্তার পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ইইউ’র পদক্ষেপে সম্পৃক্ত হয়েছে তারা। পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
চীন বরাবরই শিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এদিন ইইউর নিষেধাজ্ঞার জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে মোটেও দেরি করেনি তারা।
রাজনীতিবিদসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১০ কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে চীন৷ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘ব্যাপক হস্তক্ষেপ’ এবং ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের’ কারণে তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে সোমবার জানিয়েছে বেইজিং৷
বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ক্ষতিকরভাবে মিথ্যা ও ভুল তথ্য’ ছড়ানোর কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকজন ব্যক্তি ও চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে৷
তালিকায় ইউরোপীয় ইউনিয়েনের পাঁচ সংসদ সদস্যের মধ্যে আছেন রাইনহার্ড বুটিকোফার, মিশায়েল গাহলার, রাফায়েল গ্লুকসমান, ইলহান কিউচুক ও মিরিয়াম লেক্সমান৷ এছাড়াও তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জার্মান মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ আদ্রিয়ান সেন্স, যিনি তিব্বত ও শিনজিয়াং এ সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন৷ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে জার্মানির প্রতিষ্ঠান মার্কেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজ ও ডেনিশ একটি সংস্থা৷
চীন জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পরিবার চীনের মূল ভূখণ্ড এবং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হংকং ও ম্যাকাওয়ে প্রবেশ করতে পারবেন না৷ সেই সঙ্গে তারা যেসব কোম্পানি ও ইনস্টিটিউট এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সেগুলোও চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না৷
নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তরা এখন থেকে চীনে প্রবেশ ও ব্যবসা করতে পারবেন না। তাদের বিরুদ্ধে শিনজিয়াং নিয়ে চীনের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের গুরুতর ক্ষতি করার অভিযোগ এনেছে বেইজিং।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তাদের ‘ভুল সংশোধন’ এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে চীনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ এটিকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা৷
ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, চীন তাদের নীতি বদল এবং ইইউর ন্যায্য উদ্বেগকে বিবেচনায় নেয়ার বদলে আবারো একচোখা সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ দেশটির পদক্ষেপকে তিনি দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন৷
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সাসোলি বলেছেন, বেইজিং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন প্রণেতাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছে তার পরিণতি তারা ভোগ করবে৷
চীনের পদক্ষেপকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটা৷ এই ব্যাপারে চীনের রাষ্ট্রদূতকে দেশটি তলব করেছে বলেও জানান তিনি৷ একই ধরনের পদক্ষেপের নিয়েছে ফ্রান্সও৷ চীনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্রাসেলস ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানিয়েছেন বেলজিয়ামের উপ প্রধানমন্ত্রী সোফি উইলমস৷
সম্প্রতি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে ‘সংশোধনাগার শিবির’-এ উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বেশ কিছু নথি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। দেশটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, উইঘুর মুসলিম নারীদের জোর করে বন্ধ্যা করে দিচ্ছে চীন। শিশুদের তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। জোর করে সরকার নিয়ন্ত্রিত এতিমখানায় নিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শিনজিয়াংয়ের পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন ক্যাম্পে কমপক্ষে ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে আটক রাখা হয়েছে। চীন এসব ক্যাম্পের কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এগুলো আসলে প্রশিক্ষণকেন্দ্র। উগ্রবাদী মানসিকতা প্রশমনে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের পর চীনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হয় জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো।
অধিকারকর্মী এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছে কমপক্ষে ১০ লাখ মুসলিমকে। তারা এবং পশ্চিমা রাজনীতিকরা এক্ষেত্রে চীনের বিরুদ্ধে নির্যাতন, জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা এবং বন্ধ্যাকরণের অভিযোগ তুলেছেন। তবে জবাবে চীন দাবি করে, এসব শিবিরে উগ্রপন্থিদের ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই শিক্ষা দরকারি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ