সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামে হামলার ঘটনায় গ্রামবাসীর দায়ের করা মামলায় প্রধান আসামি যুবলীগ নেতা ও ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে আটক করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
শুক্রবার (১৯ মার্চ) গভীর রাতে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থেকে স্বাধীনকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানান সিবিআইয়ের সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ আহমদ। পিবিআই জানিয়েছে, দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়ন যুবলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও মেম্বার স্বাধীন নোয়াগাঁয়ের হামলার ঘটনায় সক্রিয় ছিলেন। তার বাড়ি উপজেলার নাচনি গ্রামে।
গত ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দুদের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার পর থেকেই হামলাকারী হিসেবে ওঠে আসে স্বাধীন মেম্বারের নাম। হামলার পর দিন স্থানীয় হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়েরকৃত মামলায়ও স্বাধীন মেম্বারকে আসামি করা হয়।
স্থানীয়দের সূত্রে ও তাদের দেয়া একটি ভিডিও ভাইরালে জানা গেছে, হামলাকারীদের বেশিরভাগই আসে স্বাধীনের গ্রাম দিরাইয়ের নাচনি থেকে। স্বাধীন মেম্বারও হামলাকারীদের দলে ছিলেন। তার উপস্থিতিতেই হামলা হয়। স্থানীয়দের সাথে কথা বলার পর নেপথ্যের ঘটনা বেরিয়ে আসায় ধোঁয়াশা কাটতে শুরু করেছে।
সুনামগঞ্জের শাল্লার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁওয়ের হামলা ছিল পরিকল্পিত। গত বুধবার সকালে ওই হামলার সময় লুটপাটও চালানো হয়। হামলাকারীরা ৮৮টি বাড়িতে ঢুকে স্টিল ও কাঠের আলমারি-শোকেস-ওয়ার্ডরোব ভেঙে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মন্দিরের মূল্যবান জিনিস নিয়ে যায়।
এদিকে হেফাজত নেতা মামুনুল হক সমর্থকদের ওই হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার আটক ২২ জনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযানে তাদের আটক করা হয়।
এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হক বলেন, সোমবার (১৫ মার্চ) সুনামগঞ্জের দিরাই স্টেডিয়ামে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত সম্মেলনে যান হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। সম্মেলনে মামুনুল হকের দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়।
ওই ঘটনাকে ধর্মীয় উসকানি আখ্যায়িত করে ওই এলাকার মামুনুল হকের অনুসারীরা মঙ্গলবার রাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাতেই ওই যুবককে আটক করে বলে জানান ওসি।
বুধবার সকালে কাশিপুর, নাচনী, চণ্ডিপুরসহ কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামের বাসিন্দারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে নোয়াগাও গ্রামে অতর্কিত হামলা চালায়। হাজারো মানুষের আক্রমণে গ্রাম ছেড়ে আত্মগোপনে যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের স্থানীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বলেন, ‘রাতেই উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সকালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। তারপরও ওই গ্রামবাসীর নিরাপত্তায় পুলিশের আগাম ব্যবস্থা না নেয়া রহস্যজনক। পুলিশ তৎপর থাকলে এমন ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।’
নোয়াগাঁও গ্রামের ভানুরঞ্জন দাস বলেন, হামলাকারীরা শোকেসের ড্রয়ারের তালা ভেঙে ৯০ হাজার টাকাসহ মেয়ের স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। এ হামলায় আরেক ভুক্তভোগী ফুলতারা রানী দাস। তিনি বলেন, হামলাকারীরা গ্রামে ঢোকার পর দৌড়ে পালানোর সময় কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরতে চেয়েছিলাম। ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে রাখা স্বর্ণের অলঙ্কারগুলো নিতে চেয়েছিলাম। ততক্ষণে হামলাকারীরা বাড়ির পাশে চলে আসায় ঘরে ফেরার সাহস পাইনি। রাতে এসে দেখেছি, ঘরের বেড়ায় দায়ের কোপ, ওয়ার্ডরোবটি ভেঙে তছনছ, ড্রয়ারে থাকা ১০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। কানের দুল ও স্বর্ণের চেইনও নিয়ে গেছে। কয়েকটা ভালো শাড়িও নিয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎ চন্দ্র দাস ঘরের ভেতরেই ছিলেন। দু’দফায় আক্রমণ করে ঘরের দরজা ভেঙে হামলাকারীরা তার ঘরে ঢোকে। এই মুক্তিযোদ্ধার গায়ে থাকা মুজিব কোট নিয়ে প্রথমে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করে তারা। পরে তাকে টানাহেঁচড়া শুরু করে। একপর্যায়ে টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার যা আছে বের করে দেওয়ার কথা বলে তারা। বাধ্য হয়ে তিনি শোকেস থেকে ১০ হাজার টাকা বের করে দেন।
ঝুমন দাস আপনের স্ত্রী সুইটি রানী দাসও বাড়ি ছাড়েননি। তিনি বাঁশের টাইলে (ধান রাখার পাত্র) লুকিয়ে ছিলেন। হামলাকারীরা ফেরার সময় শাড়ির আঁচলের অংশ দেখে আবার ঘুরে গিয়ে চুলে ধরে তাকে টেনে বের করে। একজন বলে ওঠে ঝুমনের স্ত্রী। এ সময় গালি দিয়ে আক্রমণ চালানোর কথা বললে আরেকজন এসে তার ঘাড়ে রোল দিয়ে আঘাত করে। সুইটি মাফ করে দেওয়ার জন্য বলেন। দু’জন চিৎকার দিয়ে তখন কানের দুল ও গলার চেইন দেওয়ার কথা বলে। সুইটি কানের দুলে হাত দিতে চাইলে, তারা সময় না দিয়ে নিজেরাই খুলে নেয়। পরে সুইটি শোকেস থেকে ১০ হাজার টাকা দেন। টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে ফিরে যায় হামলাকারীরা।
গ্রামের অসীম চক্রবর্তী বলেন, আমার বাড়ির বিষ্ণুমন্দিরে ঢুকে মাটির প্রতিমা ভাঙা হয়েছে। শত শত বছর আগের কষ্টিপাথরের প্রতিমা নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।
গ্রামের বাসিন্দা ইউপি চেয়ারম্যন বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল বলেন, কেবল এই পরিবারগুলো নয়, সবার ঘরের ভেতরেই চলেছে তাণ্ডব। সব বাড়িতেই ঘর যতটা না ভাঙচুর করেছে, ঘরের ভেতরের আলমারি, শোকেস, ওয়ার্ডরোব তার চেয়ে বেশি ভাঙচুর করেছে। মূলবান জিনিস রাখার একটি জিনিসও ভাঙার বাকি নেই। ভেঙে তছনছ করে লুটপাট করা হয়েছে।
শাল্লা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলামিন চৌধুরী বলেন, হামলাকারীরা যেসব বাড়িতে ভাঙচুর করেছে, সেই ৮৮ বাড়িতে গিয়েই দেখেছি টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার এবং মূল্যবান জিনিস লুট হয়েছে। আলমারি, শোকেস যাদের ছিল, সবারটাই ভেঙে লুটপাট চালানো হয়েছে। যাওয়ার সময় হামলাকারীরা ফেসবুক লাইভে বলে গেছে এক কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি করে গেছে। এই লাইভের ভিডিও ফুটেজ গ্রামের অনেকের কাছেই আছে। এই কথাগুলো ফেসবুক লাইভে বলার সময় দেশবাসীকে দেখারও আহ্বান জানিয়ে গেছে হামলাকারীরা।
সংশ্লিষ্ট বিশিষজ্ঞরা বলেন, ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনা পুরো দেশকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিলো। তখনও ফেসবুকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজনের নামকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছিলো। কোন ফেসবুক আইডিতে ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে কিংবা সেখানে কী লেখা হয়েছে, সেটি আসল আইডি কিনা এ সম্পর্কে অধিকাংশের কোন ধারণাই থাকেনা। প্রতিবাদকারীরা এগুলো যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেন না। এটা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতার জোর।
আর এসবের প্রায় সবই করে থাকেন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। বিগত বিএনপি-জামাত আমলে এর হার লক্ষ্যণীয় অবস্থানে চলে গিয়েছিল। একইসাথে বিষয়টি খুবই আতঙ্কের ছিল। আওয়ামী লীগ আসাতে হিন্দু সম্প্রদায় কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারলেও এমনসব ঘটনা যখন পুনরাবৃত্তি হতে দেখেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা অসহায় হয়ে পড়েন। আর সেটা যদি হয় আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, তখন বিষয়টি আরো আতঙ্কের পর্যায়ে চলে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ