ভাওরখোলা গ্রামের শাহজাহান সরকারের ছেলে ফারুক আব্বাসী এলাকার মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি তিনি। আলোচিত ওই খুনের সময় তার পরিচিতি ছিল ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে। আব্বাসীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ছয়টি খুনের অভিযোগ রয়েছে। মানুষকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার বেশ কিছু মামলারও প্রধান আসামি তিনি।
সর্বশেষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারিতে সন্ধ্যায় তার বাহিনী নিয়ে ভাওরখোলা গ্রামের একটি ঘরে ঢুকে একই পরিবারের ছয়জনকে কুপিয়ে জখম করেন। তাদের মধ্যে নাজমা বেগম (৬৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। তার স্বামী আবদুস সালামেরও হাত-পা কেটে ফেলেছেন এই ভয়ংকর সন্ত্রাসী। সালাম এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ জগতে আব্বাসীর তাণ্ডব
২০০১ সালের পর ফারুক আব্বাসী বিএনপিতে যোগ দেন। তৎকালীন সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান হন। সরকার পরিবর্তন হলে ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পুনরায় ভাওরখোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন।
সূত্র মতে, ১৯৯০ সালে ফারুক আব্বাসী অভাব-অনটনের কারণে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপর ঢাকার হাজারীবাগে চলে যান। সেখানে গিয়ে ট্যানারিতে কাজ শুরু করেন। পুরান ঢাকার ট্যানারি কারখানাগুলোতে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ধীরে ধীরে অপরাধ জগতের ডন হয়ে ওঠেন। ঢাকা শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় নাম ওঠে তার।
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় পরের বছরের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তাদের মধ্যে ফারুক আব্বাসীর নামও রয়েছে। পরে উচ্চ আদালতে আসামিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে আব্বাসী ফিরে আসেন ভাওরখোলা গ্রামের নিজ বাড়িতে। সেখানে এসে গড়ে তোলেন নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী। এলাকায় শুরু করেন মাদক ব্যবসাসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে গত তিনবারের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যানও হন।
সর্বশেষ গত ইউপি নির্বাচনে আব্বাসীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হন একই গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম সিরাজ। তবে সন্ত্রাসী আব্বাসীর সঙ্গে টিকতে পারেননি তিনি। ওই নির্বাচনে পরাজিত হয়ে পরিবার নিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন সিরাজ।
পাঁচ বছর পর ঢাকা থেকে এক ভাতিজির বিয়েতে পরিবার নিয়ে গ্রামে আসেন সিরাজ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আব্বাসী। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় আব্বাসীর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী রামদা, চায়নিজ কুড়ালসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে সিরাজুল ইসলামদের ঘরে হামলা চালায়। এ সময় তারা নারী-পুরুষ যাকে যেখানে পেয়েছে, কুপিয়ে জখম করেছে। ওই হামলায় নিহত হন সিরাজের ভাবি নাজমা বেগম।
সোনারগাঁয়ে ট্রিপল মার্ডার সম্পর্কে জানা যায়, ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের নামকরা পরিবার সুলতান হাজীর ছেলে মিজানুর রহমানের সঙ্গে তার ছোট বোন লাকী আক্তারের বিয়ে হয়। এক পর্যায়ে ওই পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে ফারুক আব্বাসী সুলতান হাজীর মেয়ে ও দুই নাতিকে ঢাকায় নিয়ে হত্যা করে লাশ ডাস্টবিনে ফেলে রাখেন। ওই ঘটনায় তার নামে হত্যা মামলা হয়। বিএনপি সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পান তিনি।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে
ফারুক আব্বাসীর বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলায় সাক্ষী হওয়ায় নিজের চাচাতো ভাই লিটন আব্বাসীকে কুপিয়ে জখম করেন। এখন তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না।
লিটন আব্বাসী জানান, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যার পর এলাকায় এসেই ভয়ংকর হয়ে ওঠেন ফারুক আব্বাসী। এরই মধ্যে সোনারগাঁয়ে একটি ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা ঘটান তিনি। এ ছাড়া ঢাকায় আরেকটি হত্যাকাণ্ডে তার নাম রয়েছে। জমি দখল, বাড়ি নির্মাণে চাঁদাবাজি, মেয়েদের বিয়ে থেকে চাঁদা আদায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি সবই করেন তিনি। তিনি ইউনিয়ন পরিষদেও যান না, বাড়িতে বসেই সব কাজ সারেন।
মেঘনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম জানান, ২০০৯ সালে মেঘনা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাকে গুলি করেন ফারুক আব্বাসী। ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ভাওরখোলা গ্রামের আবদুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির গায়ে লাগে। তিনি এখন পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
ফারুক একাধিক খুনের মামলার আসামি। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তবে তার বিরুদ্ধে এলাকার কেউ ভয়ে কথা বলতে চান না। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোঃ সিরাজুল ইসলাম জানান, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি ফারুক আব্বাসী। তিনি একসময় ঢাকা শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার ভুক্তভোগীরা বলেন, শফিকুল ইসলাম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ফারুক দেশ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ইউপি চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে আবার শুরু হয় ফারুক আব্বাসীর নেতৃত্বে তার দলবলের অপকর্ম।
ধর্ষণ থেকে শুরু করে অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম, জোর করে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা ওঠানো, সাধারণ মানুষের অন্তত ৫০০ বিঘা ফসলী জমি দখল করে মাছ চাষ, বাল্যবিবাহ সার্টিফিকেট বেচাকেনা, আরও বহু অপকর্মে জড়িত তিনি। তার দুটি অস্ত্র রয়েছে। এর বাইরেও ভাই ও সহযোগীদের অস্ত্রের মহড়ায় এলাকার মানুষ আতঙ্কে আছে।
মামলা প্রসঙ্গে মেঘনা থানার ওসি আবদুল মজিদ জানান, নাজমা বেগম হত্যাকাণ্ডের পর শুক্রবার রাতে ভাওরখোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফারুক আব্বাসী ও তার ভাই খোকন আব্বাসী, ইমরান হোসেন টিটু, ইয়ার আব্বাসীদের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে বাঁশসহ ১০৬টি ও বাঁশ ছাড়া ৬৭টি কান্তা, ১৬টি ছোরা, চারটি ধামা, ছয়টি চাইনিজ চাপাতি, দুটি কুড়াল, ১২টি টেঁটা ও দুটি রড উদ্ধার করা হয়েছে।
নিহতের দেবর সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত ইউপি চেয়ারম্যান ও তার লোকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছে। এ ছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আরও একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করে। মামলায় দেলোয়ার হোসেন নামের এক আসামিকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার রায়পাড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া চেয়ারম্যান ও তার ভাইসহ সহযোগীদের বিরুদ্ধে এ থানায় আরও একটি মামলা রয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে।
তিনি আরও বলেন, মামলায় অভিযুক্ত চেয়ারম্যানের কাছে লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও একটি শর্টগান রয়েছে। অস্ত্র দুটির লাইসেন্স বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি পাঠানো হবে।
একই পরিবারের তিন জনকে হত্যা
আব্বাসীর স্বজনেরা জানান, ২০০০ সালের দিকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের সুলতান হাজির ছেলে মিজানুর রহমানের সঙ্গে ফারুক আব্বাসীর ছোট বোন লাকী আক্তারের বিয়ে হয়। একপর্যায়ে ওই পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে সুলতান হাজির মেয়ে রীনা (৩০) ও তার দুই সন্তান শাবনী (৭) ও অনীককে (৫) আব্বাসী হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় করা মামলার এখনো বিচার শেষ হয়নি।
মামলার বাদী নিহত রীনার ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, ২০০৩ সালে রীনা আর তার দুই বাচ্চাকে সোনারগাঁ থেকে ঢাকায় নিয়ে যান আব্বাসী ও তার বোন লাকী। এরপর মোহাম্মদপুর এলাকার ডাস্টবিনে লাশ পাওয়া যায় তাদের। নিহত শিশু দুটির শরীরেরও সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ ছিল।
এ ঘটনায় হাবিবুর সোনারগাঁ থানায় অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা করেন। সেই মামলায় আব্বাসীর দুই ভাই গ্রেপ্তার হলেও ফারুক আব্বাসী গ্রেপ্তার হননি। মামলাটি এখনো নারায়ণগঞ্জ দ্বিতীয় জজ আদালতে বিচারাধীন।
ক্ষমতার উৎস
এলাকায় চাঁদাবাজি করে আব্বাসী বাহিনী। স্থানীয় কৃষকদের জমিতে জোর করে মাছ চাষের (মাছের প্রজেক্ট) অভিযোগ রয়েছে আব্বাসীর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২০১৯ সালে স্থানীয় কৃষকেরা মেঘনা-হোমনা আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
আব্বাসীর ক্ষমতার উৎস কোথায়, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলছেন না। আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আব্বাসী।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলে আব্বাসীর কখনোই কোনো পদ ছিল না। তিনি কী করে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পান, তা নিয়ে তখন সবাই বিস্মিত হয়েছিলেন। কার শেল্টারে আব্বাসী চলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে তার কর্মকাণ্ডে স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও বিব্রত।
আর মেঘনা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ মিয়া রতন শিকদারও বলেন, দলীয়ভাবে তারা আব্বাসীকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। আব্বাসী গত নির্বাচনে মিথ্যাচার করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আনেন বলে দাবি তার।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪৭
আপনার মতামত জানানঃ