পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম রোস্তম আলীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ইউজিসির নীতিমালা অমান্য, অনৈতিকভাব নিয়োগ, পদোন্নতিসহ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি, বারবার প্রমোশন নীতিমালা পরিবর্তন, ভিন্নমতের মানুষদের চাকুরিচ্যুত করা ও দুর্নীতসহ আরও বহু অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে একাই প্রতীকী অনশনে বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আব্দুল আলিম। অনশন থেকে তিনি উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।
আজ মঙ্গলবার(১৬ মার্চ) সকাল এগারোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সহকারী অধ্যাপক ড. এম আব্দুল আলীম এই কর্মসূচি পালন করেন।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে ১০১টি অভিযোগ এনে তিনি এ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। ১০১টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে চলমান প্রায় ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অনিয়ম, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অনিয়ম, আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষকদের হয়রানিসহ নানা অভিযোগ।
ড. আব্দুল আলিম সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, যোগদানের পর থেকেই উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রোস্তম আলী ক্ষমতার অপব্যবহার করে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ভিন্নমত পোষণকারীদের নানাভাবে হয়রানি করেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে উপাচার্য গণমাধ্যমকে বলেন, কেন তিনি অনশন করছেন তা উনিই ভালো বলতে পারবেন। তার অভিযোগের কথা ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে।
এর আগেও গত বছরের নভেম্বর মাসে উপাচার্য এম. রোস্তম আলীর দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিবাদে আট দফা দাবিতে একক অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বাংলা বিভাগের ওই সহযোগী অধ্যাপক।
শিক্ষক আব্দুল আলীম ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগে বলেন, ভিসি রোস্তম আলী যোগদানের পর থেকেই একের পর এক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থিক-প্রশাসনিক ও একাডেমিক অনিয়ম-দুর্নীতি করে চলেছেন। চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ভিসি আবদুস সোবহানকে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য বানানো, শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে চেম্বার তছনছ, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যক্তিগত ফাইল ঘেঁটে হয়রানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন পদে পছন্দের শিক্ষকদের বসিয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট করা, শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি, ক্ষমতার অপব্যবহার করে কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে শিক্ষকদের শাস্তি প্রদান, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পদোন্নতি আটকে রাখা, রাজাকার পরিবারের সন্তান বলে অপবাদ দেওয়া, শহীদ মিনার নির্মাণসহ পাঁচশ কোটি টাকার উন্নয়নকাজে অনিয়ম, ১০ কোটি টাকার বই ক্রয়ে কারসাজি করে টেন্ডার প্রদান, পরিবহন খাতে অনিয়ম, পদোন্নতি নিয়োগে অনিয়মসহ আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে।
অবস্থান কর্মসূচিতে ড. আব্দুল আলীম নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম তদন্ত, বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের পাঁচশত কোটি টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতিসহ আট দফা দাবি তুলে ধরেন।
তার দাবির মধ্যে রয়েছে:—
১. ইউজিসির তদন্তে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আব্দুস সোবহানকে পাবিপ্রবি রিজেন্ট বোর্ড থেকে অপসারণ।
২. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের পাবিপ্রবিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল। দায়িত্ব পালন না করে মাসের পর মাস গ্রহণ করা তাঁদের বিপুল অঙ্কের টাকা এই বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ফেরত আনা। মানবেতর জীবনযাপনকারী খণ্ডকালীন শিক্ষককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান।
৩. অনৈতিকভাবে সংশোধন করা সর্বশেষ শিক্ষকদের প্রমোশন নীতিমালা ও নিয়মভঙ্গ করে দেওয়া শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল,শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা মেনে পদোন্নতি।
৪. সদ্য অর্গানোগ্রাম থেকে বাদ দেওয়া আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট পুনরায় চালু এবং ইন্সটিটিউটে এডহক-ভিত্তিতে চাকরি করা শিক্ষকদের বন্ধ বেতন পুনরায় চালু করতে হবে এবং চাকুরি নিশ্চিতকরণ।
৫. শিক্ষক-হয়রানি বন্ধসহ, উপাচার্য কর্তৃক শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিংবাজি বন্ধ করতে হবে।
৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে নিয়োগকৃত চেয়ারম্যান/ডিনদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং নিয়োগ-সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন । ৭. উপাচার্য কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফাঁকি দেওয়া বিপুল অঙ্কের বাড়িভাড়া বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ফেরত দিতে হবে।
৮. বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তবায়নাধীন প্রায় ৫শত কোটি টাকার প্রকল্পের কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ।
গত বছরের ৫ নভেম্বর পাবিপ্রবি উপাচার্য এম রোস্তম আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তথ্য প্রমাণসহ অভিযোগ পেশ করে প্রতিকার চান কিছু শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা আমলে নিয়ে ভিসি রোস্তম আলীর অনিয়ম ও দূর্নীতি তদন্তের নির্দেশ দেন। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি ) প্রফেসর ড. মো. আবু তাহেরকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পত্র দেয়।
তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টিসহ ড. আব্দুল আলীম অভিযোগগুলো আবারও উল্লেখ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে তা মিথ্যা উল্লেখ করে পাবিপ্রবি ভিসি প্রফেসর এম. রোস্তম আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের মাধ্যমে কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার প্রথম ও শেষ পাতায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতিবাদ লিপি ছাপান।
ব্যক্তিগত অপরাধ আড়াল করতে কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল অর্থ ব্যয়কে অনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়ছে, বিষয়টা একদিকে যেমন লজ্জাজনক অন্যদিকে বিপজ্জনক। এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন শিক্ষকদের অধীনে পড়াশোনা করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী অর্জন করবে এবিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেন। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আসে। এসব একটি রাষ্ট্র কিংবা জাতির ভিত নষ্টের আলামত বলে মনে করেন তারা।
তারা জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি দেশ ও জাতীর জন্য যেমন কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত, প্রতিষ্ঠানটি তেমনি সংবেদনশীল। এখানেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বেড়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া হয়। যারা এক সময় দেশ ও জাতীর হাল ধরবেন। দেশকে নিয়ে যাবেন আরও উন্নত কোনো স্বপ্নের দিকে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যখন বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়, তখন শিক্ষার বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। আর এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির সাথে যখন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়ে তখন তারা পরবর্তী প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিচ্ছেন আর কেমন করে বেড়ে উঠাতে তারা ভূমিকা রাখছেন, চিত্রটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে আসে।
তারা বলেন, দেশের বর্তমান সামগ্রিক এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আর রাষ্ট্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছনে এসব দুর্নীতিবাজ ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া শিক্ষকদের ভূমিকাই শীর্ষস্থানীয় বলে মনে করেন তারা। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/ডিএস/কেএইচ/২১২৩
আপনার মতামত জানানঃ