
ইউরোপীয়রা যখন সমুদ্রপথে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ শুরু করে, তখন তারা মানচিত্র অনুসরণ করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে আসতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতি, পণ্যভান্ডার ও বন্দরনগরীগুলো তাদের আকৃষ্ট করে। এর ফলে সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে ইংরেজ, পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, ডেনিশসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ইউরোপীয় বণিকরা বাংলায় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে থাকে।
এই ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে শুধু খ্রিস্টানরা ছিলেন না, বরং ইহুদি ব্যবসায়ীরাও ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তাদের আগমন ও কার্যক্রম সম্পর্কে জানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিঠিপত্র ও প্রশাসনিক রেকর্ড থেকে। ১৬৭৯ সালে লন্ডনের ইহুদি বণিক জ্যাকব জেসুরুন আলভারেজ কলকাতায় আসেন তার আত্মীয় জন মেন্ডেজ দ্য কোস্টার সঙ্গে দেখা করতে। এই ঘটনা বাংলায় ইহুদি বাণিজ্যের সূচনা হিসেবে গণ্য করা হয়।
মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ দুর্গ ছিল ইহুদি বণিকদের প্রথম সংগঠিত কেন্দ্র। সেখানে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্রচ্ছায়ায় বসতি স্থাপন ও বাণিজ্য পরিচালনা শুরু করেন। ১৬৮৭ সালের একটি নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে বলা হয়, ইহুদি বণিকদের বাংলার যেকোনো পণ্য ইংল্যান্ডে পাঠানোর অনুমতি রয়েছে। ১৬৯৮ সালে আরেক ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে থাকা ইহুদি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বণিকরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী হবে।
আলভারো দা ফনসেকা নামে এক ইহুদি বণিক ১৬৯৩ সাল থেকে বাংলায় ইহুদি বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটান। তিনি ও তার সহকারী ডোমিঙ্গো দ্য কোস্টা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রায় ২৫ হাজার মুদ্রার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন এবং সাফির নামক জাহাজে করে বাংলায় পণ্য পাঠান। এই কার্যক্রম ইহুদি বণিকদের বাংলায় আরও প্রতিষ্ঠিত করে তোলে।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় আব্রাহাম জ্যাকবস নামে এক ইহুদি বণিক ইংরেজ বন্দিদের জন্য খাদ্য ও প্রয়োজনীয় রসদ পাঠান এবং এর মাধ্যমে ইংরেজদের কাছে সম্মান অর্জন করেন। পেত্রোস আরাতুন নামে এক আর্মেনীয় বণিকের চিঠিতে তাকে স্পষ্টভাবে ইহুদি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে জানা যায়, ইহুদি বণিকরা শুধু ব্যবসায়ীই ছিলেন না, বরং রাজনীতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
লর্ড কর্নওয়ালিস যখন বাংলার গভর্নর জেনারেল ছিলেন, তখন ইহুদি বণিকরা বাংলায় স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু করেন। সেই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি উদ্যোক্তা ছিলেন ইসরায়েল লেভিন সলোমনস। তিনি আমস্টারডাম থেকে লন্ডনে পাড়ি জমিয়ে ‘দ্য হোয়াইট হাউজ’ নামে এক বিলাসবহুল ভবনে পরিবার নিয়ে বাস শুরু করেন এবং বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
সলোমনস শুধু ইউরোপে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশেও শক্তিশালী বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। তিনি মাদ্রাজের মোজেস দ্য ক্যাস্ত্রো ও জ্যাকব বার্নেটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। ক্যাস্ত্রোর পরিবার ছিল লন্ডনের ধনাঢ্য ইহুদি ব্যবসায়ী পরিবার, যাদের সঙ্গে ভারতের হীরার ব্যবসা ছিল দীর্ঘদিনের। মোজেস দ্য ক্যাস্ত্রো যখন মাদ্রাজে অবস্থান করতেন, তখনই সলোমনসের সঙ্গে তার চিঠিপত্র চালাচালি শুরু হয়।
১৭৮০ সালের দিকে ক্যাস্ত্রো মাদ্রাজ থেকে চলে গেলে সলোমনসের প্রতিনিধি হিসেবে জ্যাকব বার্নেট বাংলায় যান। বার্নেট শুরুতে মাদ্রাজে থাকলেও পরে বেনারসে চলে যান এবং হীরার ব্যবসা শুরু করেন। তিনি দ্য ক্যালকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের ব্যবসার ঘোষণা দেন এবং বাংলায় ইহুদি বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বার্নেট নিয়মিতভাবে সলোমনসকে বাংলার বাজার পরিস্থিতি জানাতেন এবং তাকে নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ করতেন। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৭৮৫ সালে সলোমনস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তার প্রতিনিধি লিওন প্রেগারকে পাঠানোর আবেদন করেন। কোম্পানি সলোমনসের গুরুত্ব বিবেচনায় আবেদন গ্রহণ করে এবং অনুমতি প্রদান করে।
এই সিদ্ধান্ত ছিল কেবল ব্যক্তিগত উদ্যোগ নয়, বরং এটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাণিজ্য নীতির ভেতর ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি কৌশলগত সাফল্য। এর মাধ্যমে মাদ্রাজ থেকে বাংলায় ইহুদি বাণিজ্যের স্থানান্তর নিশ্চিত হয় এবং বাংলাকে এক নতুন ইহুদি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা শুরু হয়। ইসরায়েল লেভিন সলোমনসের এই সিদ্ধান্ত বাংলায় ইহুদি ডায়াস্পোরার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকে।
আপনার মতামত জানানঃ