অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের বাইরে থেকে মনে হয় স্বর্গসুখে আছেন তারা৷ আসলে ঘরের কোণে, পথে-প্রান্তরে, অফিস-আদালতে অস্ট্রেলীয় নারী আর উপমহাদেশ, আফ্রিকা বা আরব অঞ্চলের নারীদের মাঝে খুব বেশি পার্থক্য নেই৷ অস্ট্রেলিয়ায় ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সি নারীদের অনেকে পাঁচ বছর আগেই জানিয়েছেন পুরুষ কতটা নির্মম আচরণ করে আসছে তাদের ওপর৷ সে দেশের ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকস এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে দেশময় নীরবে চলছে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, ধর্ষণ,যৌন নিপীড়ন৷ শারীরিক নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করতে হচ্ছে নারীদের৷ এসবের বিরুদ্ধে এবার স্মরণকালের সেরা এক প্রতিবাদ ঘটে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়।
যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ জানাতে এবং নারীদের সমতা নিশ্চিত করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় এক লাখের বেশি নারী আজ সোমবার(১৫ মার্চ) বিক্ষোভ করছেন। ক্যানবেরা, সিডনি, মেলবোর্নের মতো বড় শহরসহ প্রায় ৪০টি শহরে সে দেশের নারীরা পদযাত্রায় অংশ নেন।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি যৌন নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসে। এ ঘটনার জেরে সে দেশের নারীরা ‘বিচারের জন্য পদযাত্রা’ করছেন। এতে অংশগ্রহণকারীদের অনেককে নানা স্লোগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করতে দেখা যায়। যেমন কোনোটিতে লেখা ছিল, ‘আপনারা শুনছেন না’, কোনোটিতে ছিল, ‘আপনারা কতজন ভুক্তভোগীর খবর রাখেন?’ অধিকাংশ বিক্ষোভকারীর পরনে ছিল কালো পোশাক।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সোমবারের ওই কর্মসূচির আওতায় ক্যানবেরা, সিডনি, মেলবোর্নের মত প্রধান শহরগুলোসহ প্রায় ৪০টি শহরে নারীরা পদযাত্রায় সামিল হয়েছেন।
বিবিসির খবরে বলা হয়, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিবাদের অংশ বিক্ষোভ করছেন তারা।
খবরে বলা হয়, দেশটিতে ধর্ষণের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। এ নিয়ে সেখানকার রক্ষণশীল সরকার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই এই বিক্ষোভ চলছে।
সপ্তাহ খানেক আগে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। ওই সময় ১৯৮৮ সালের একটি ধর্ষণের ঘটনায় অ্যাটর্নি জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান পোর্টারের নাম উঠে আসে, যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন।
আরেকটি ঘটনাও তখন প্রকাশ্যে আসে। সাবেক-রাজনৈতিক পরামর্শক ব্রিটনি হিগিন্স ফেব্রুয়ারিতে অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালে সহকর্মীর হাতে এক মন্ত্রীর অফিসে তিনি ধর্ষণের শিকার হন। যা নাগরিকদের বিক্ষুব্ধ করে। এসব ঘটনার পরেই অস্ট্রেলিয়াজুড়ে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জোরালো হয়েছে।
আজকের বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন ব্রিটানি হিগিন্স। সমাবেশে উপস্থিত থেকে ব্রিটানি হিগিন্স বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ায় নারীদের যৌন নির্যাতনের ব্যাপারে ভয়াবহ রকমের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আমার ঘটনাটি সামনে এসেছে এই কারণে যে, এটি নারীদের মনে করিয়ে দিয়েছে- এমন ঘটনা সংসদেও ঘটতে পারে এবং সত্যিকারার্থে যে কোনো জায়গায় এ ধরনের বিশ্রী ঘটনা ঘটতে পারে।
আন্দোলনকারীদের মতে, যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়।
পদযাত্রার আয়োজকদের প্রত্যাশা, এই প্রতিবাদ হবে ‘অস্ট্রেলিয়ায় ঘটা এ পর্যন্ত নারীদের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ।’
গত সোমবার অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল চার্লস ক্রিস্টিন পোর্টার দেশটির সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এবিসির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া শুরু করেন। এবিসি নাম প্রকাশ না করে দেশটির একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আইনজীবীরা বলছেন, প্রতিবেদনটি পড়ে অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তাকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
এছাড়া সম্প্রতি বিরোধী লেবার পার্টির নারী সদস্যরা ফেসবুকে একটি পেজ খুলেছেন। সেখানে পুরুষ সহকর্মী ও রাজনীতিবিদদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার বিস্তারিত অভিযোগ তুলে ধরেছেন তারা।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার পার্লামেন্টে ধর্ষণের অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় যৌন নির্যাতন
অস্ট্রেলিয়ায় নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের হার ভারতীয় উপমহাদেশের চাইতেও কম নয়। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি ছয় নারীর একজনকে শারীরিক বা যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ওই নারীরা তাদের সঙ্গীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
এআইএইচডব্লিউ জানায়, অস্ট্রেলিয়ায় পনেরো লাখেরও অধিক নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। প্রতি ছয় নারীর একজন সঙ্গীর হাতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রতি চারজনের তিনজনই পুরুষের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা জরিপ সংস্থা আইভিএডাব্লিউএস জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় অবিবাহিত নারীরাও সাবেক বা বর্তমান ছেলে বন্ধু বা সঙ্গীর কাছে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ কোনো সম্পর্ক নেই এমন পুরুষের নির্যাতনের শিকার হারই বরং কম, কোথাও কোথাও নাকি ছয় জনে মাত্র একজন৷
নির্যাতকদের কদর্যতা ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়৷ প্রেমিকা বা সঙ্গিনীকে বলা হচ্ছে, ‘‘শরীর দেখা যায় এমন পোশাক কখনো পরবেনা, অন্য পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করবেনা, টেলিফোনে যার-তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ” ।
এদিকে বিয়ে করলে বিবাহিত জীবনে নারীদের অনেক ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা বলতে তেমন কিছু থাকেনা৷ সন্তান হলে অস্ট্রেলিয়ার অনেক মেয়েও ছেড়ে দেয় চাকরি৷ তারপরই শুরু হয় বিপদ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলেছেন স্বামী সব রকমভাবে তাদের বন্দি করে রাখতে ক্রেডিট কার্ড কেড়ে নিয়ে বাতিল করেছে, মোবাইল ব্যবহারেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা, যখন তখন বাইরে বেরোনো অনেক মায়ের কাছে যেন বেশি কিছু চাওয়া, এমনকি বাবা-মায়ের কাছে যাওয়াও নিষিদ্ধ৷
অবশ্য নারীর অবস্থা এবং অনেক পুরুষের আচরণের সঙ্গে মিল দেখা গেলেও নারীর নিরাপত্তা বিধানে সরকারের ভূমিকা দেখলে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার পার্থক্য মানতেই হবে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু আইন করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার৷ ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে জানালে পুলিশি ব্যবস্থার নিশ্চয়তা তো আছেই, এ কারণে বিশেষ ছুটিও অচিরেই পাবেন নির্যাতিতারা৷ এছাড়া নারী এবং শিশুদের নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে ১২ বছর মেয়াদি এক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৯
আপনার মতামত জানানঃ