গত মাসে কানাডার সীমান্ত নিরাপত্তা সংস্থা জালিয়াতির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি কলেজে ভর্তির পর ১৫০ জনেরও বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে।
অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। দেশটির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জারি করছে নিষেধাজ্ঞা।
স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে আরও বৃহত্তর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম।
কোভিড-১৯ পরবর্তী অস্ট্রেলিয়ায় প্রতারণামূলক স্টুডেন্ট ভিসা আবেদন বৃদ্ধি পেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এটি করতে গিয়েই বেশ কয়েকটি রাজ্যে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ভিসা জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পরে। এদের ভিসা বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে।
অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম দ্য এজ এবং দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের একটি তদন্তে দেখা গেছে, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, এডিথ কোওয়ান ইউনিভার্সিটি, দ্য ইউনিভার্সিটি অফ উলংগং, টরেন্স ইউনিভার্সিটি এবং সাউদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটির জন্য কাজ করা এডুকেশন এজেন্টদের বিরুদ্ধে ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। এই এজেন্টগুলো শুধু ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ভিসা সংক্রান্ত কাজ করে থাকে।
গত মাসে কানাডার সীমান্ত নিরাপত্তা সংস্থা জালিয়াতির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি কলেজে ভর্তির পর ১৫০ জনেরও বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ভারতের একটি অভিবাসন পরামর্শ সংস্থার মাধ্যমে তারা প্রতারিত হয়েছে। ওই সংস্থাগুলো তাদের জাল ভিসা সরবরাহ করেছিল।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার এবং উচ্চ শিক্ষা খাতে উদ্বেগ রয়েছে যে দেশটির অভিবাসন ব্যবস্থা এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অভিবাসীরা কাজের অধিকার পেতে সহজ পথ হিসেবে স্টুডেন্ট ভিসা পদ্ধতির সঙ্গে জালিয়াতি করছে।
কোভিড-১৯ মহামারির পর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সীমানা পুনরায় খোলার পর থেকে আবেদন প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে ।
বিগত মরিসন সরকার স্টুডেন্ট ভিসাধারীদের প্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা কাজের সীমাবদ্ধতা সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আবেদন বেড়েছে।
বিশেষ করে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বার্ষিক আবেদনগুলো মহামারির পর উচ্চ হারে বেড়ে গেছে। এ বছর ৭৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২ দেশের মধ্যে নাগরিকদের ভ্রমণ এবং অধ্যয়ন সহজ করার জন্য একটি বিস্তৃত চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভিসা আবেদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
হোম অ্যাফেয়ার্স সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, ‘২০২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারি পরবর্তী সীমানা বিধিনিষেধ শিথিল করার পর থেকে তারা অসম্পূর্ণ আবেদনের বৃদ্ধি এবং স্টুডেন্ট ভিসার আবেদনগুলোতে জালিয়াতির তথ্য প্রত্যক্ষ করেছে।’
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে হোম অ্যাফেয়ার্স অস্ট্রেলিয়ার বৃত্তিমূলক সেক্টরে পড়াশোনা করার জন্য ভারত থেকে ৯৪ শতাংশ আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শিক্ষা সংস্থাগুলোকে অভিযুক্ত করেছে যে, তারা কমিশনের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতে সাহায্য করে এবং আবেদনকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়।
এর আগে গত মার্চ মাসে ভিসাসংক্রান্ত কাগজপত্র জাল পাওয়ায় সাত শতাধিক ভারতীয় শিক্ষার্থীকে ফেরত পাঠিয়েছে কানাডা কর্তৃপক্ষ। এই শিক্ষার্থীরা কানাডিয়ান বর্ডার সিকিউরিটি এজেন্সির (সিবিএসএ) কাছ থেকে দেশে ফিরে আসার চিঠি পান।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই শিক্ষার্থীরা জলন্ধরে অবস্থিত এডুকেশন মাইগ্রেশন সার্ভিসেসের মাধ্যমে শিক্ষা ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন। এডুকেশন মাইগ্রেশন সার্ভিসেসের প্রধান ব্রিজেশ মিশ্র। তিনি এই শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের কাছে প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউট হাম্বার কলেজে ভর্তি ফিসহ সব খরচ বাবদ ১৬ লাখ টাকার বেশি নিয়েছেন। কিন্তু এতে উড়োজাহাজের টিকিট ও সিকিউরিটি ডিপোজিট অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
পড়াশোনার জন্য এই শিক্ষার্থীরা ২০১৮–১৯ সালে কানাডায় যান। এই শিক্ষার্থীরা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের (পিআর) জন্য আবেদন করার পর ‘ভর্তির অফার লেটার’ যাচাই-বাছাইয়ে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। সিবিএসএ কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে নিশ্চিত হয় যে এই শিক্ষার্থীদের ‘ভর্তির অফার লেটার’ আসল নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে তাদের পড়াশোনা শেষ করে কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন। কেউ কেউ চাকরির অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন। স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করেই তারা এই সমস্যার মুখোমুখি হলেন।
১০ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের কানাডায় পাঠানোর কাজ করা জলন্ধরভিত্তিক একজন পরামর্শক বলেছেন, এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে একাধিক কারণ জড়িত। কলেজের ভুয়া অফার লেটার পাওয়া থেকে শুরু করে ভিসা আবেদনের জন্য শিক্ষার্থীদের ফি প্রদানের ভুয়া রসিদও দেওয়া হয়। কারণ, কলেজে ফি জমা দেওয়ার পরই ভিসা দেওয়া হয়।
কাপুরথালার একজন পরামর্শক বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে এমন কলেজের অফার লেটার দেওয়া হয়েছিল, কানাডায় যাওয়ার পর সেখানে শেষ পর্যন্ত তারা পড়তে পারেননি। তাদের অন্য কোনো কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল বা পরবর্তী সেমিস্টারের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ ভিসার জন্য আবেদন করার সময় নথিতে যে সেমিস্টারে দেখানো হয়েছিল, সেই সেমিস্টারে তারা পড়তে পারেননি।’
এই পরামর্শক আরও বলেন, পড়াশোনার জন্য বিপুলসংখ্যক ভারতীয় শিক্ষার্থী কানাডায় যেতে চান। এই বিষয়কে পুঁজি করে কিছু প্রতারক এজেন্ট কানাডাভিত্তিক একটি বেসরকারি কলেজের সঙ্গে যোগসাজশে এসব করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ৭০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন শিক্ষার্থী বলেছেন, তিনি কানাডার একটি সরকারি কলেজ থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন। ভিসার আবেদন করার সময় তাকে বেসরকারি কলেজে ভর্তির অফার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কানাডা যাওয়ার পর তাকে সরকারি কলেজে ভর্তির কথা বলা হয়। এ জন্য এজেন্ট তার ফি ফেরত দিয়েছিল এবং নতুন কলেজে ভর্তির জন্য সহায়তা করেছিল।
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, পরামর্শদাতা তাকে বলেছিলেন, তিনি কানাডায় পৌঁছে কলেজ পরিবর্তন করতে পারেন। এ রকম বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা এজেন্টকে কিছু কমিশন দেওয়ার পর কানাডায় পৌঁছে তাদের কলেজ পরিবর্তন করে নেন।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছেন, এজেন্ট তাদের ফি ফেরত দিয়েছে। এ কারণে তারা অন্য কলেজে ভর্তি হয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে তারা কানাডা সরকারকে কিছু অবহিত করেননি। ফি ফেরত দেওয়ায় এজেন্টকে তেমন একটা সন্দেহ হয়নি।
অন্য একজন পরামর্শক বলেছেন, এসব ক্ষেত্রে যে কলেজ ভর্তির অফার লেটার দিয়েছিল, তাদের ভূমিকা অবশ্যই যাচাই করা উচিত। তারা (কলেজ) আসলেই এই অফার লেটার দিয়েছিল নাকি, এজেন্ট ভুয়া অফার লেটার তৈরি করেছিল তা দেখতে হবে। এ ধরনের কলেজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, শিক্ষার্থীরা এ ধরনের বিষয়গুলো বেশির ভাগই জানেন না।
তবে এটা নতুন কোন ঘটনা নয়। এর আগে ২০১৯ সালে সহস্রাধিক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ভুয়া কাগজপত্র এবং ভিসার শর্তসমূহ মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়া সহ বিভিন্ন কারণে তাদের ভিসা বাতিল করা হয়। ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স-এর তথ্য মতে, ওই বছর ১,১০০ এরও বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ