জাতিসংঘ যেন যুক্তরাষ্ট্রেরই মুখপাত্র। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণের বিষয় সর্বজনবিদিত। যখন যেখানে খুশি জাতিসংঘকে দিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো অপরাধকে জাতিসংঘ দিয়ে ধুয়েমুছে ফেলা ইত্যাদিসহ যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছে। একইসাথে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে। এবার এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াল বিশ্বের কয়েকটি দেশ। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা নিরসনে এবার জোট বাঁধতে যাচ্ছে ইরান, রাশিয়া এবং চীনসহ ১৬টি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের একনায়কতান্ত্রিক আচরণ মোকাবিলায় জোটবদ্ধ হচ্ছে তারা। খবর রয়টার্স
এ জোটে আরো রয়েছে সিরিয়া, ফিলিস্তিন, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা এবং কিউবা। এছাড়া প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ হিসেবে অন্য যেসব থাকবে তারা হলো- আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, বেলারুশ, বলিভিয়া, ক্যাম্বোডিয়া, ইরিত্রিয়া, লাওস, নিকারাগুয়া সেইন্ট ভিনসেন্ট এবং গ্রেনাডিন্স দ্বীপপুঞ্জ।
এসব দেশের সমন্বয়ে সম্ভাব্য জোট গঠনের বিষয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হাতে কিছু তথ্য পড়েছে যার বরাত দিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছে, মার্কিন-বিরোধী এসব দেশ মনে করে বহু পাক্ষিকতাবাদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীনভাবে আমেরিকা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশটি শাস্তিতমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিভিন্ন দেশের ওপর জোর করে নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে, কখনো কখনো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে যা একাধিপত্যবাদের চূড়ান্ত লক্ষণ। আমেরিকার কারণে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বলেও দেশগুলো মনে করে।
সম্ভ্যাব্য জোট গঠনকারী দেশগুলোর প্রায় সবাই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে রয়েছে। এর মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির পরও ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে আমেরিকা। এছাড়া, প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে চীনের বিরুদ্ধে এবং ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করার জন্য মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন।
এদিকে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কায়ানি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে বিশ্ববাসীর সামনে নিজের সন্ত্রাসী চেহারা উন্মোচনা করে দিয়েছে। আমরা অপরাধী যুক্তরাষ্ট্রের হাড়গোড় ভেঙে ফেলব এবং ওই শব্দ সময়মতো মানুষের কানে পৌঁছাবে।
কায়ানি ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনি যোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রশংসা করে বলেন, ইয়েমেনের সাহসী যোদ্ধারা খালি হাতে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের কাছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও নিরাপদে থাকার জন্য দেশটি সীমান্তে এক মিটার চওড়া ও ছয় মিটার উঁচু প্রাচীর তৈরি করছে।
চীনের বিরুদ্ধে জোট
এদিকে চীনকে ঠেকাতে আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার নেতারা আজ ‘কোয়াড’ কাঠামোর প্রথম শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন৷ চীনের বেড়ে চলা আগ্রাসী মনোভাবের প্রেক্ষাপটে এই ভার্চ্যুয়াল আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে৷
প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর শাসনকালে চীন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজস্ব ক্ষমতা জাহির করার যে ‘বেপরোয়া’ মনোভাব দেখিয়ে চলেছে, তার ফলে উদ্বিগ্ন একাধিক দেশ৷ চীনকে চাপে রাখতে আমেরিকা ও আঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ছে৷
২০০৭ সালে গঠিত ‘কোয়াড’ বা চতুর্দেশীয় এক কাঠামোর আওতায় ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার সঙ্গে নিয়মিত সামরিক মহড়া চালিয়ে এসেছে৷ এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই কাঠামোকে আরও মজবুত করতে এই প্রথম চার দেশের শীর্ষ বৈঠকের উদ্যোগ নিচ্ছেন৷
আজ শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে মিলিত হবেন।
এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যেসব আন্তর্জাতিক জোটকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন, তার মধ্যে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিতে অগ্রাধিকার স্পষ্ট।
কথিত ‘কোয়াড’ দেশগুলোর নেতাদের প্রথম বৈঠকে ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানা যায়। অর্থাৎ, শুধু চীনের বিরুদ্ধে একজোট হতেই এই বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করার পথ করে রাখছে দেশগুলো। সিডনিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এমন দাবি করেছেন।
মরিসন বলেন, এটা হবে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আগামীকাল(আজ) আমাদের বৈঠক। অস্ট্রেলীয়দের জন্য যখন আমরা এই অবিশ্বাস্য গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসব—আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি—আপনাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, ‘এখানে আরও বহু বৈঠক হয়ে আসছে। কিন্তু যখন সরকারগুলোর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব একসঙ্গে বসেন, তখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পুরোপুরি নতুন মাত্রার এক সহযোগিতার নোঙ্গর ফেলা হবে।
চীনের ক্রমবর্ধমন রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক তৎপরতা প্রতিরোধে সম্ভাব্য জোট হিসেবে গ্রুপটিকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই ভার্চ্যুয়াল বৈঠক দুঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে, যা চলতি বছরের শেষে এর নেতাদের মধ্যে সরাসরি বৈঠকের ভিত্তি তৈরি করে দেবে।
স্কট মরিসন বলেন, যখন এ অঞ্চলের দেশগুলো নতুন জ্বালানি অর্থনীতিতে প্রবেশ করবে, তখন যাতে অপরিহার্য কার্বন নির্গমনও নিস্ক্রীয় করা যায়—তা নিয়েও এ বৈঠকে আলোচনা করা হবে।
চীনের বেড়ে চলা আগ্রাসী মনোভাব আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেলেও অ্যাজেন্ডায় করোনা সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ও স্থান পাবে৷ অর্থাৎ শুধু চীনের বিরুদ্ধে একজোট হতেই এমন সহযোগিতার কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, এমন অভিযোগ খণ্ডন করতে চায় এই চার দেশ৷ ফেব্রুয়ারি মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায়ও সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করা হয় নি৷ তবে বেইজিং এমন জোট সম্পর্কে অস্বস্তি গোপন করছে না৷ ভারতের উপকূলের কাছে চার দেশের বিশাল যৌথ সামরিক মহড়ার কড়া সমালোচনা করেছে চীন৷
ভারত-চীন নিয়ন্ত্রণ রেখায় লাগাতার উত্তেজনা ও সংঘর্ষ থেকে শুরু করে পূর্ব ও চীন সাগরের উপর অধিকার কায়েম করতে চীনের একতরফা পদক্ষেপের মতো ‘বেপরোয়া’ পদক্ষেপ সম্পর্কে গোটা অঞ্চলে অস্বস্তি বাড়ছে৷ চীনের শিনচিয়াং প্রদেশে উইগুর জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন এবং হংকং-এর মানুষের অধিকার সংকুচিত করার উদ্যোগও সমালোচনার মুখে পড়ছে৷ সম্প্রতি তাইওয়ানের প্রতি চীনের মনোভাব আরও কড়া হয়ে ওঠায় সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করছে কিছু মহল৷ চীনের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া মনোভাব চালিয়ে যাবার ইঙ্গিত দিয়েছেন বাইডেন৷ তবে যেখানে সম্ভব সহযোগিতার সুযোগও কাজে লাগাতে চায় ওয়াশিংটন৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ