বেঢপ জ্যাকেট, মোটা ভুরু, আর উস্কোখুস্কো চুলের মি. বিন গত তিন দশক ধরে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে মানুষকে। আজ থেকে প্রায় ২৯ বছর আগে বৃটেনের টিভিতে প্রথম প্রচার হয়েছিল জনপ্রিয় কমেডি শো মি. বিনের প্রথম পর্ব। পরবর্তীতে এই মি. বিন পরিণত হয়েছিল পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটিতে।
অভিনয়ের দক্ষতা এই নামটিকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আর এই ব্র্যান্ডের আড়ালে সেই অভিনেতার যে আসল নাম ঢাকা পড়ে গেছে, তা হচ্ছে রোয়ান অ্যাটকিনসন। ১২ বছর পর্যন্ত নিজের চোখে টেলিভিশন দেখার সুযোগ হয়নি তার। তবে বর্তমানে যেসব শিল্পী নির্বাক ছবিতে অভিনয় করে সবাক যুগের মানুষকে অবাক করে যাচ্ছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
ব্যক্তিজীবনে অ্যাটকিনসন
অসামান্য প্রতিভাবান এই অভিনেতার পুরো নাম ‘রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন’ আর ডাকনাম ‘রো’। তুঙ্গ-স্পর্শী জনপ্রিয় অ্যাটকিনসন ইংল্যান্ড এর কনসেট কাউন্টি ডারহামে ১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে চার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন অ্যাটকিনসন। তার বাবার নাম ছিল এরিক অ্যাটকিনসন। যিনি পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। এছাড়াও তিনি ছোট একটি কোম্পানির দেখাশোনা করতেন। আর মায়ের নাম ছিল এলা মে। তার তিন ভাইয়ের এক ভাই ‘পল’ খুব ছোট থাকতেই মারা যায়, এক ভাই ‘রোডনী’ একজন অর্থনিতীবিদ এবং অন্যজনের নাম ‘রুপার্ট’। ভাইদের মধ্যে সবার ছোট মি. বিন।
ছোটবেলা থেকেই অ্যাটকিনসন হাসিখুশি একজন মানুষ ছিলেন। তবে তিনি কম কথা বলতেন। অ্যাটকিনসনের শখ হলো স্পোর্টস কার সংগ্রহ করা। নিজের টেনিস কোটের চারপাশে তার ছোট রেসিং কার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে তিনি অনেক আনন্দ পান। যদিও এটি বলা বাহল্য রোয়ান অ্যাটকিনসন হচ্ছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা সেলিব্রিটিদের অন্যতম।
১৯৯০ সালে মেকআপ আর্টিস্ট সুনেত্রা শাস্ত্রীকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের সংসারে রয়েছে দুটি সন্তান- বেন এবং লিলি। দীর্ঘ দুই যুগ একসঙ্গে সংসার করার পর ২০১৫ সালে রোয়ান অ্যাটকিনসনের সঙ্গে সুনেত্রা শাস্ত্রির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সংসার ভাঙ্গার কারণ হিসেবে জানা যায়, অ্যাটকিনসন আবার প্রেমে জড়িয়েছেন। সংসার বিচ্ছেদের জন্য সুনেত্রা লন্ডনের সেন্ট্রাল ফ্যামিলি কোর্টে আবেদন করলে মাত্র ৬৫ সেকেন্ডের শুনানিতে তার আবেদন মঞ্জুর করে আদালত।
জানা যায়, রোয়ান দেড় বছর ধরে লুইস ফোর্ড নামের একজন টেলিভিশন তারকার সঙ্গে ডেট করে আসছেন।
পড়াশোনা
অ্যাটকিনসন প্রাথমিক পড়াশোনা করেছেন ডারহ্যামের কোরিস্টার্স স্কুলে। এরপর সেন্ট বিস স্কুলে। ১৯৭৫ সালে তিনি নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং কুইন্স কলেজ থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৬ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানজনক ফেলো ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া স্কুল-কলেজগুলোতে তিনি নিজের প্রতিভার জানান দিয়ে আসছিলেন। মি. বিনের স্কুলসঙ্গী ছিলেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার।
লেখক অ্যাটকিনসন
টিভি অনুষ্ঠান আর চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে মানুষের মন জয় করলেও অ্যাটকিনসন শুরুর দিকে কিন্তু লেখালেখি করেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার লেখা কমেডি ধারার দুটি বই ‘নট দ্য নাইট’ ও ‘ক্লক নিউজ’ দিয়ে ১৯৭৯ এর দিকে বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা পান এবং ব্রিটিশ একাডেমি থেকে জিতে নেন বেশ কিছু পুরষ্কার। পরবর্তিতে এই বইগুলো থেকে টিভি কমিক অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হয় যাতে অভিনয় করেছিলেন তিনি নিজেই।
অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ এবং প্রতিবন্ধকতা
অ্যাটকিনসনের ডারহামের কাথেড্রাল স্কুলে একটি ফিল্ম সোসাইটি ছিল। সেই ফিল্ম সোসাইটির প্রধান বিষয় ছিল হাসি ও শিশুতোষ বিষয়ক সিনেমা। স্কুলে যখন চার্লি চাপলিনসহ আরো অনেকের কমেডি মুভিগুলো দেখতেন, তখন থেকেই তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। যে কারণে বারবার অভিনয়ের সুযোগ হারিয়েছেন মি. বিন।
অক্সর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে অভিনয়ের প্রতি আবারো আগ্রহ জন্মায় তার। তারপর একটি কমেডি গ্রুপে যোগ দেন। এরপর অভিনয়ের দিকে মনোযোগী হলে সেখানেও একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। কমেডি গ্রুপে তার কথার তোতালামির কারণে তিনি ভালো করতে পারেনি। তার তোতলামির কারণে অনেকগুলো টিভি শো থেকে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে ফিরিয়ে দেয়। হতাশায় তার চারপাশ ঘিরে ধরে। এরপরও সে নিজের উপর বিশ্বাস হারাননি।
হঠাৎ একদিন বিনের সঙ্গে পরিচয় হয় রির্চাড কার্টিস নামে একজন নাট্যকার ও গীতিকার অভিনেতার সঙ্গে। রির্চাড কার্টিস ও অ্যাকটিনসনের দুজনে মিলে অক্সর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন ‘অক্সর্ফোড নাট্যশালা’। তারা দুজনে বিবিসি রেডিও থ্রিতে ‘দ্য অ্যাটকিনশন পিপলস’ নামে একটি স্যাটারিক্যাল ইন্টারভিউধর্মী অনুষ্ঠাসে পারর্ফম করতেন। ১৯৮৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পায় অ্যাকটিনসনের অভিনত মুভি ‘Dead on time’। একই বছরের অক্টোবরে মুক্তি পায় রোয়ান অ্যাকটিনসনের অভিনীত জেমস বন্ড সিরিজের ছবি never say never again মুভিটি। এই মুভিটিতে অ্যাকটিনসন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন।
মি. বিন হিসেবে পর্দায় আগমন
১৯৯০ সালের পহেলা জানুয়ারিতে ‘মি. বিন’ নিয়ে টেলিভিশন পর্দায় হাজির হন রোয়ান অ্যাটকিনসন। মি. বিনের নাম প্রথমে ছিল মিস্টার হোয়াইট। পরে তার নাম হয় মি. বিন। এরপর থেকে টানা বিশ বছর তিনি এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
মি. বিন মূলত ১৪ পর্বের একটি হাস্যরসাত্নক ব্রিটিশ টিভি ধারাবাহিক। আইটিভি নামক টেলিভিশন চ্যানেলে এর প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়। মি. বিন ছাড়াও তিনি ‘ব্ল্যাকাডার’ ও ‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক নিউস’ নামে দুটি কমেডি স্কেচ শো এবং হলিউড অ্যাকশন কমেডি ‘জনি ইংলিশ’ এর জন্যও সুপরিচিত। তিনি ‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক’ এ দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য ১৯৮১ সালে BAFTA এর নিকট থেকে Best Entertainment Performance পুরষ্কার জিতেন।
২০০৫ সালে রম্য দর্শকের ভোটে ব্রিটিশ কমেডি ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ৫০ কমেডিয়ানদের তালিকায় নাম উঠে রোয়ান অ্যাটকিনসনের।
রোয়ান অ্যাটকিনসন ২০১১ সালে বিবিসির এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি যখন ছাত্র তখন থেকেই মি. বিনের মতো একটি চরিত্রের ধারণা তার মাথায় গড়ে উঠেছিল।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজ গুলোর মধ্যে আছে ১৯৯৪ সালে অভিনয় করেন ‘ফোর ওয়েডিং এন্ড এ ফুনেরাল’ সিনেমাতে। একই সালে ভয়েস দেন ‘লায়ন কিং’ এ। ২০০৩ সালে একজন জুইয়েলারি বিক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করেন ‘লাভ একচুয়েলি’ সিনেমাতে। থিয়েটারে অসাধারণ অভিনয় করার জন্য ১৯৮১ সালে জিতেন অলিভার অ্যাওয়ার্ড। মি. বিন এর দুটি চলচ্চিত্র আর ইংলিশ ফিল্ম সিরিজ জনি ইংলিশ (২০০৩-২০১৮) দিয়েও তিনি সিনেমাটিক সাফল্য অর্জন করে নেন।
মিস্টার বিনকে অ্যাটকিনসনের বিদায়
দ্রুতগতির গাড়ি রোয়ানের খুবই পছন্দের। তাই ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ফর্মুলা ওয়ান স্পোর্টস কার বেছে নিয়েছেন তিনি। এ ধরনের স্পোর্টস কার পৃথিবীতে রয়েছে মাত্র ১০০টি। ২০১১ সালের ৫ আগস্ট তিনি ওই গাড়িতেই অ্যাক্সিডেন্ট করেন এবং তার কাঁধে অপারেশন করতে হয়।
ওই বছর নভেম্বরে অ্যাটকিনসন ডেইলি টেলিগ্রাফকে বিন চরিত্রে আর না আসার ঘোষনা দেন। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, এ চরিত্রটি তাকে দিন দিন শিমুতে রূপান্তর করে দিচ্ছে। এ চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার জন্য যে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয়, সেটিও তিনি পাচ্ছেন না। এছাড়া তার মতে, একজন পঞ্চাশ ঊর্ধ্বের ব্যক্তিকে শিশুসুলভ অভিনয় করাটা একেবারেই বেমানান। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে সে সিরিয়ালধর্মী চরিত্রগুলোতেই শুধু অভিনয় করবেন।
কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার নেয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। ব্রিটেনের ডেইলি স্টার পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে রোয়ান বলেন, ‘প্রবীণ বয়সে আমরা মি. বিনকে নিয়ে কি কি করাতে পারি আর ঠিক কি রকমের হাস্যরস তার থেকে বের করে আসতে পারি সেটা সত্যি বেশ মজার ব্যাপার হবে। আর একজন বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করা হবে আমার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
মানুষের সামনে মি. বিনকে উপস্থিতই করা হয়েছে এমনভাবে যেন সে সামাজিক রীতিনীতির বাইরের একটা কিছু। তার ট্রাউজার মাপে একটু ছোট, তার জ্যাকেট ফ্যাশনদুরস্ত নয়, তার টাইও বেমানান। সে একটু অস্বাভাবিক ধরণের, এবং আশপাশের লোকদের সাথে সে যা করছে তা একেবারেই অদ্ভূত।
পিটার বেনেট জোনস বলেন, মি. বিন যে সব বয়েসের দর্শকের কাছে এবং এতগুলো দেশে জনপ্রিয় হয়েছে তার কারণ হলো এর সার্বজনীনতা। মি. বিনের কাজ-কারবার সবাইকেই হাসাতে পারে। এর হাস্যরস বোঝার জন্য কোন শিক্ষার দরকার নেই, কোন ভাষারও দরকার নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১৩
আপনার মতামত জানানঃ