বাংলা চলচ্চিত্রের দীর্ঘদিন ধরে দুঃসময় চলছে। সিনেমা হলে আসছেন না দর্শকরা, মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ করছেন না নির্মাতারা। ফলে ব্যবসায়িক লোকসান গুণতে হচ্ছে সিনেমা হল ব্যবসায়ীদের। আসলে বহুমুখি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। সিনেমার এক সময়ে প্রাণকেন্দ্র বিএফডিসির ছন্নছাড়া অবস্থা থেকে দেশের সিনেমা বাণিজ্যিক বাজারে দুর্দশা শুরু হয়েছে। রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীররা যেই ইন্ডাস্ট্রির স্বর্ণযুগ তুলে দিয়ে গেছেন তাদের উত্তরসূরীদের হাতে তা নব্বই দশক পর্যন্ত উজ্জ্বল থাকলেও সেই ঝলমলে ইন্ডাস্ট্রি নিভু নিভু হওয়া শুরু হয় দিনদিন। যার পরিণতি এখন চলচ্চিত্র শিল্পের শুনশান অবস্থা। অব্যাহত ব্যবসায়িক মন্দার কারণে দেশের সিনেমা হলগুলো থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে একের পর এক সিনেমা হল। সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠছে বিপনী বিতান র্দীঘদিন ধরে। কিন্তু এই সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকার থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের কারোরই যেন মাথা ব্যাথা নাই।
চলচ্চিত্র শিল্পের মজবুত খুটিতে ঘুন ধরার দিকে খেয়াল ছিল না কারো। সিনেমায় অশ্লিলতা, পাইরেসি ব্যবসা হয়ে উঠে কেন্দ্রিয় ব্যবসা। গুটি কয়েক দর্শক ছাড়া হল বিমূখ হতে শুরু করে দেশের সিনেমা প্রেমীরা। হলগুলো চলে যায় অনিয়ন্ত্রণে। দর্শকরা ঝুঁকে পড়েন বিদেশি সিনেমার দিকে। তখন ক্যাবল টিভির সুবিধা নিতে থাকেন তারা। হল থেকে ড্রয়িংরুমে ঢুকে গেলেন তারা। এরপর সিনেমায় সেই অশ্লিলতা আর পাইরেসি থেকে অনেকটা বের হলেও যাদের হাতে শিল্পটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল তারা সরে গেলেন শিল্পমান থেকে। বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার দিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হলো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মানে নাক চিটকানো ব্যাপার হয়ে উঠলো তথাকথিত সুশীলদের কাছে। কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্পের এই দুর্দশা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে কারো ছিল না উদ্বেগ।
দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের এমন কঠিন সময়ে হলগুলো সচল রাখতে হিন্দি ছবি প্রদর্শনের প্রস্তাব উঠেছে। এমন প্রস্তাব বেশ আগে থেকে সিনেমা হলগুলোর মালিকদের পক্ষ থেকে উঠলেও পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পী সমিতির বিরোধীতার মুখে বেশিদূর এগুতে পারেনি। তাদের দাবী ছিল বাংলাদেশে হিন্দিসহ বিদেশি চলচ্চিত্র সিনেমাহলগুলোতে প্রদর্শন করা হলে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংসের মূল কারণ হচ্ছে পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পীদের অপেশাদার কার্যক্রম, দর্শকের চাহিদা বিবেচনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ না করা এবং বাস্তবতার নিরিখে সিনেমা হলগুলোর সংস্কার না করা। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংসের পেছনে মূলত দায়ী এই তিন পেশাজীবি সমিতি। দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় নির্মাতারা ছবির অভাব পূরণ করতে পারছেন না বলে সিনেমা হল বন্ধ ঠেকানো যায়নি। সীমিত আকারে হলেও ভারতীয় ছবি আমদানির দাবি জানিয়ে আসছিলেন হল মালিকরা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে অবশেষে সিনেমা হলগুলোকে বাঁচাতে এবং সিনেমা হল বন্ধ ঠেকাতে হল মালিকদের দাবীর মুখে বাংলাদেশের সিনেমাহলগুলোতে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রর্দশনের ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক, প্রযোজক ও পরিচালক সমিতির নেতারা। আগেই বলেছি সিনেমা হল বন্ধ ঠেকাতে সীমিত আকারে হলেও ভারতীয় ছবি আমদানির দাবি জানিয়ে আসছিলেন দেশের হল মালিকরা। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই তিন সংগঠনের এই ঐক্যমতে আসা বলে জানিয়েছেন তিন সমিতির নেতারা গণমাধ্যমকে।
সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে করে হল মালিকরা বছরে দশটি ভারতীয় হিন্দি ছবি আমদানি করে প্রদর্শনের প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে বছরে ১০টি সিনেমা আমদানির আশ্বাসও পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। হল মালিক ও প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার হিন্দি ছবি আমদানির আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা বছরে ১০টার বেশি হিন্দি ছবি আমদানির প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের প্রস্তাবে সরকারের কাছ থেকে সায় মিলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে হিন্দি সিনেমা আমদানির অফিসিয়াল অনুমতি পেলেই আমরা চিন্তা করব কোন হিন্দি সিনেমাগুলো প্রদর্শন করব আমরা।
এর আগে প্রযোজক, পরিচালক এবং প্রদর্শক সমিতির নেতারা নিজেরা বৈঠক করেন। সেখানে বৈঠক শেষে হিন্দি ছবি আমাদানীর ব্যাপারে একমত হন তারা। চলচ্চিত্র দর্শকদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, দেশে হিন্দি ছবি আনার অনুমতি পেলেও আপাতত তা প্রদর্শনের জন্য উপযুক্ত নয় দেশের সিনেমা হলগুলো। এমন অভিযোগের জবাবে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার বলিউডের ছবি আমদানির অনুমতি দিলে মালিকপক্ষ তাদের সিনেমা হল সংস্কারের কাজ শুরু করবেন এবং সংস্কারের কাজ দ্রুত শেষ করে সিনেমা হলগুলো দর্শকের উপযোগী করে তুলবেন।
বাংলাদেশের সিনেমা হলে হিন্দি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের খবরে দর্শকদের মধ্যে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আগ্রহ যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনি দেশে হিন্দি ছবি প্রদর্শন হলে দেশের চলচ্চিত্র একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নজন মতামত জানাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ধ্বংস হওয়ার বাকি আর কিছু নাই, এই শিল্পটি ইতিমধ্যে মৃত প্রায়।
মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা নামের একজন ফেসবুকে প্রতিক্রিয়ায় জানান, “বাংলাদেশে হল ব্যবসা চলবে না। বাংলা হোক, হিন্দি হোক কিংবা ইংলিশ সিনেমা। ৭০% মানুষের হাতের নাগালে ইন্টারনেট আছে, আছে নেটফ্লিক্স৷ মানুষ অনলাইনেই হাতে মুভি দেখে নেয়। সময় নষ্ট করে সিনেমা হলে যাবে না কেউ।”
এর বিপরীত মতামতও অনেকে দিয়েছেন। এমডি কবির নামের একজন লিখেছেন, “হিন্দি সিনেমার বাজার যদি খুলে দেওয়া হয় দর্শক আবারো হলমুখি হবে নিশ্চিত। কেজিএফ চ্যাপটার টু দিয়ে চালু করা হোক। বর্তমানে দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দেশের মুভি রেগুলার দেখে বিভিন্ন সাইট থেকে ডাউনলোড করে প্রতিনিয়তই। সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি ফ্রিক ইন্ডিয়ান সিনেমার সবচেয়ে বড় বাজার এখন বাংলাদেশে। এখানে রেগুলার হাজার হাজার সিনেমা নিয়ে আলোচনা করে মুভিখোর লাভার-রা। আমি মনে করি অন্য দেশের সিনেমা মুক্তি দিলে, তাদের সিনেমা দেখে ভালো মানের সিনেমা তৈরি করার চেষ্টা করবে বাংলাদেশের পরিচালকরা! অল্প বাজেটে ভালো সিনেমা হয়, বিগ বাজেট লাগে না, উদাহরণ হিসেবে বুঝে নিতে হলে মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির দিকে একবার নজর দিলেই বুঝতে পারবেন আশাকরি।”
আল আমিন নামের একজন ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, হিন্দি সিনেমা হলে চললে একদল লোক হলমুখী হবে অন্তত। আর বাংলা ছবির ভরসায় থাকলে আগামী এক বছরে সব সিনেমা হল বন্ধই হয়ে যাবে।
ফেসবুকে ‘বাংলা চলচ্চিত্র‘ নামের চলচ্চিত্র বিষয়ক গ্রুপের মূখ্য এডমিন ও টিভি নাটক নির্মাতা সীমিত রায় অন্তর এ প্রসঙ্গে স্টেটওয়াচকে বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের এখন যে অবস্থা, তা থেকে এই উদ্যেগ উত্তরনের পথ হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারন এর আগেও ভারতীয় হিন্দি সিনেমা হলে চালানো হয়েছিল, তাতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। এটা আসলে একটা অন্ধকারে ঢিল ছুড়ার মতো। এটা চেষ্টা বলা চলে। মানুষ এখন হলবিমুখ। ভাল সিনেমা নেই, ভাল সিনেমা হলও নেই।
নির্মাতা জনাব অন্তর আরও বলেন, তবে যদি এই হিন্দি সিনেমার উসিলায় দেশের সিনেমা হলগুলোর সংস্কার হয়, পরিবেশ ভাল হয়, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সরকারকে অবশ্যই দেশীয় সিনেমা বাঁচানোর জন্য হিন্দি সিনেমার ট্যাক্স দেশী সিনেমা হতে ২০ গুন বেশী হতে হবে এবং মাসিক একটা সংখ্যা নির্ধারন করে দিতে হবে হিন্দি সিনেমার জন্য। নইলে হিন্দি সিনেমার ভীড়ে বাংলাদেশের সিনেমা হারিয়ে যাবে। আমি আশা করবো, সরকার নিজেদের সিনেমার স্বার্থে যা যা করার দরকার, তা করেই হিন্দি সিনেমা আমদানীর সুযোগ দিবেন।
তবে অধিকাংশের মতামত হচ্ছে, সমগ্র বিশ্বে মুক্ত ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির যুগে মানুষকে আর আটকে রাখা সম্ভব না। মানুষ তাঁর বিনোদন ক্ষুধা মেটানোর জন্য প্রয়োজনে টাকা খরচ করে তার পছন্দের সিনেমা দেখবেই। সস্তা দেশপ্রেমের নামে বিদেশি সিনেমা প্রদর্শন আটকে রাখা এ সময়ে বোকামী ছাড়া ভিন্ন কিছু না। দেশে দর্শকদের রুচি ও চাহিদানুযায়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে না পারার ব্যর্থতা প্রযোজক ও পরিচালকদের। সেই দায় দর্শক বা সিনেমা হলগুলো কেন নেবে? শুধু হিন্দি সিনেমা নয়, বিশ্বের সাড়া জাগানো সবদেশের ও ভাষার সিনেমা আমদানী করার অনুমতি দেওয়া উচিত। বিদেশি চলচ্চিত্র যেমন বাংলাদেশে দর্শকদের আবার হলমূখি করবে, পাশাপাশি প্রতিযোগীতায় পড়লে দেশে ভালো নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা দেশের মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ভাল নির্মাণের মাধ্যমে সেই আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তাদেরই।
হিন্দি সিনেমা আমদানির অনুমতির পাশাপাশি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারকে খুব দ্রুত চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে শিল্পের সকল সুবিধার আওতায় আনারও দাবি জানানো হয়েছে। তবে চলচ্চিত্র বিশ্লেষকদের মতে, চলচ্চিত্র শিল্পকে শিল্পের সকল সুযোগ সুবিধায় আনলেও লাভ নাই। ভাল গল্প ও ভাল নির্মাণের চলচ্চিত্র নির্মাতা না থাকলে শিল্পের সুযোগ ঘোষনা খুব একটা কাজে আসবে না। চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে হলে প্রথমে প্রয়োজন দর্শক ও আধুনিক মানসম্মত সিনেমা হল। দর্শক তৈরিতে এই মুহুর্তে প্রয়োজন দর্শকদের পছন্দ অনুযায়ী সিনেমা। সেটা পূরণ করতে পারে সিনেমা আমদানী। পাশাপাশি ভালো মানের দেশিয় সিনেমা নির্মাণে প্রয়োজন সরকারী সহযোগীতা।
বাংলাদেশে গত ৪-৫ বছরে বাংলা চলচ্চিত্রে হাওয়া কিছুটা বদল হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু সেটিরও ছন্নছাড়া অবস্থা। কয়েকটি প্রযোজনা সংস্থা বড় বাজেট নিয়ে আসে ব্যবসা করতে এই শিল্পে। কিন্তু দর্শকদের চাহিদা ও সিনেমা ব্যবসা নিয়ে গবেষণায় ঘাটতি থাকায় এখনো বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে তার স্বর্ণালি যুগের আদলে গড়তে পারেনি কেউ। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ২০২০ সাল গত কয়েক বছরের চেয়ে সম্ভাবনার বছর ছিল বলে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আবারো এক ধাক্কা খেতে হল এই শিল্পকে। সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সুযোগ আবার কবে আসবে তা এখন অপেক্ষা। এই মুহুর্তের সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন হচ্ছে দর্শকদের আবার হলমূখি করা। সেটা সম্ভব বিশ্বমানের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে।
এসডব্লিউ/নসদ/০৩১০
আপনার মতামত জানানঃ