শীত বিদায়ের সঙ্গে করোনাভাইরাসের বিধিবিধান নিয়ে ক্রমশ ধৈর্য হারাতে শুরু করেছেন ইউরোপ, আমেরিকাসহ উত্তর গোলার্ধের মানুষ৷ দেশগুলোর ওপর লকডাউন তুলে নেয়ার চাপ বাড়ছে ক্রমাগত৷ টিকা নিয়ে করোনাপরবর্তী মুক্ত জীবনের জন্যেও মুখিয়ে রয়েছেন মানুষ৷
কিন্তু সত্যিকারভাবে করোনা কবে বিদায় নিচ্ছে? সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথিত এক বিবৃতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক এসেছে সামনে৷ কয়েক মাসের মধ্যেই করোনা বিদায় নিচ্ছে, সংস্থাটির ইউরোপের পরিচালক হান্স হেনরি ক্লুগের উদ্ধৃতি দিয়ে সম্প্রতি এমন খবর প্রকাশ হয়৷ যদিও ক্লুগ পরে জার্মান সম্প্রচার মাধ্যম জেডডিএফকে জানিয়েছেন, তিনি মোটেও এমন কথা বলেননি৷ বরং খোলাসা করে বলেন, ২০২২ সালে মহামারিকে পেছনে ফেলা সম্ভব হবে তিনি এমনটাই মনে করেন৷
করোনাভাইরাস কি তাহলে হার মানতে যাচ্ছে?
বার্লিনভিত্তিক সারিটে হাসপাতালের ভাইরোলজিস্ট ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন তেমন মনে করেন না৷ তিনি বলেন, যে ধরনগুলো রয়েছে তার কোনোটি দুর্বল হয়েছে এমন কোনো ইঙ্গিত তারা দেখতে পাচ্ছেন না৷ করোনা দুর্বল হচ্ছে বা বিদায় নিচ্ছে এমন চিন্তা পুরোপুরি কাল্পনিক৷ জানুয়ারিতে ডেয়ার স্পিগেল ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বরং ২০২১ সালে পরিস্থিতি আগের বছরের চেয়ে খারাপের শঙ্কাই প্রকাশ করেছেন৷ জার্মানির মহামারি বিশেষজ্ঞ ও বুন্ডেসটাগের আইন প্রণয়নকারী কার্ল লাউটাবাখও দ্রুত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন৷
পরিসংখ্যান কী বলছে
ফেব্রুয়ারির শেষে বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৪০ লাখ৷ ২৫ লাখ মানুষ মারা গেছেন আর সাড়ে ছয় কোটি মানুষ আরোগ্য লাভ করেছেন৷ কিছু দেশের পরিসংখ্যান এখনো আতঙ্কজনক৷ এমনকি ভাইরাসটি নিজেকে যেভাবে বদলাচ্ছে, তাতে তৃতীয় ধাক্কার শঙ্কাও আছে৷
তারপরও মহামারি থেকে উত্তরণে আশার আলো দেখা যাচ্ছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেমনটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল গত দুই মাসে সংক্রমণের মাত্রা তার চেয়েও দ্রুতগতিতে কমেছে৷ জানুয়ারির মাঝামাঝিতে দৈনিক সাত লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, যা এখন অর্ধেকের কাছাকাছি নেমে এসেছে৷ গত এক মাসে মৃত্যুর সংখ্যায় কমে প্রায় অর্ধেক হয়েছে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস অ্যাডানম গেব্রেয়েসাস এই পরিসংখ্যানকে আশাব্যাঞ্জক বলে উল্লেখ করেছেন৷ তিনি মনে করেন, কোভিড-১৯-কে যে দমানো সম্ভব এবং জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদ্যোগ যে কাজে লেগেছে এই প্রবণতা থেকে সেই ইঙ্গিতই মিলছে৷
কেন কমছে
করোনার সংক্রমণ কমার পেছনে একক কোনো কারণ নেই৷ বেশ কিছু বিষয় সেখানে ভূমিকা রেখেছে, সেটি অবশ্যই বলা যায়৷ টিকাও এর একমাত্র কারণ নয়৷ কেননা, জনসংখ্যার হিসাবে বিশ্বের খুবই সামান্য একটি অংশ এখন পর্যন্ত টিকার আওতায় এসেছে৷ সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধিগুলোই যে কিছু দেশে কাজে লেগেছে, সেটি অনেকটা প্রমাণিত৷ আবার কিছু কিছু দেশে করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি বা গণপ্রতিরোধও তৈরি হচ্ছে৷ যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এরই মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে গেছেন৷ তাদের বড় একটি অংশ হয়ত পরীক্ষার আওতায়ই আসেনি৷
কোনো কোনো গবেষক এমনটাও বলছেন যে, মিউটেশন বা নিজেকে বদলাতে গিয়ে করোনার ভাইরাস যে দুর্বল হয়ে পড়ছে সেটিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এমন একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল সায়েন্স-এ৷ সেখানে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের ক্রমাগত পরিবর্তনে মহামারি দ্রুতই অতিমারিতে রূপ নেবে৷
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে আগামীকাল ৮ মার্চ । গত বছরের ৮ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম জানানো হয় তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন বিদেশফেরত এবং একজন দেশে থাকা তাদের পরিবারের সদস্য। তাদের কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
দেশ থেকে এখনো করোনা বিদায় নেয়নি, বরং অনেক মানুষের অসতর্ক আচরণের কারণে চোখ রাঙাচ্ছে। গত মাসেও করোনায় শনাক্ত বা সংক্রমণ নিচের দিকে নেমে ছিল, এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা সবার প্রতি বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহবান জানাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, সতর্কতায় শিথিলতা দেখালে যেকোনো সময় পরিস্থিতি আরো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যেতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘আমরা এখন আগের তুলনায় ভালো অবস্থায় থাকলেও কিংবা টিকা নিলেও সবাইকেই মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত করোনা নির্মূল না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ঝুঁকির মধ্যেই থাকব। ফলে সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য-উপাত্ত অনুসারে দেখা যায়, গত বছরের ৮ মার্চ থেকে শুরু করে গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে মোট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছে আট হাজার ৪৫১ জন এবং সুস্থ হয়েছে পাঁচ লাখ এক হাজার ৯৬৬ জন। এখন পজিটিভ রোগী আছে ৩৯ হাজার ৩০৭ জন। মৃতদের মধ্যে ৭৫.৫৯ শতাংশ পুরুষ এবং ২৪.৪১ শতাংশ নারী। সর্বোচ্চ ৮০.৪২ শতাংশই ছিল ৫০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ। তাদের বেশির ভাগই আগে থেকে নানা ঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে এখনো প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ১০ জন, নতুন শনাক্ত হয়েছে ৫৪০ জন এবং সুস্থ হয়েছে ৮২২ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ গড় অনুসারে দৈনিক শনাক্তের হার ৪.১৩ শতাংশ, মোট শনাক্তের হার ১৩.৩০ শতাংশ। সুস্থতার হার ৯১.৩১ শতাংশ, মৃত্যুহার ১.৫৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান জানান, গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকা দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৪৯ লাখ দুই হাজার ৯৪৮ জন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৫২ জন। টিকা নেওয়ার পর মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ৮২৫ জনের মধ্যে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ