শুভ্র সরকার : সম্প্রতি চীন নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে নতুন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, যুদ্ধবিমান, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী সাবমেরিন যুক্ত করার পর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষণ, সক্ষমতায় এরই মধ্যে মার্কিন নৌবাহিনীকে ছাড়িছে চীন।
ইউএস অফিস অব নেভাল ইন্টেলিজেন্স (ওএনআই) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে চীনা নৌবাহিনীর বহরে ২৫৫টি যুদ্ধজাহাজ ছিল। ২০২০ সালের শেষের দিকে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ এ দাঁড়িয়েছে। হিসাব বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের কাছে ৬০টি জাহাজ বেশি আছে।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী চার বছর পর, চীনের কাছে ৪০০টি যুদ্ধজাহাজ থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ওএনআই। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের নৌবহরে ৩৫৫টি জাহাজ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিএনএন বলছে, বিশ্বে মার্কিন নৌবাহিনী শ্রেষ্ঠত্ব হারাতে বসেছে। তবে, এখনও সেনা সংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নৌবাহিনীতে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার সেনা আছেন। অন্যদিকে চীনের নৌবাহিনীতে আছে ২ লাখ ৫০ লাখ সেনা।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর দূরদর্শিতা
২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট শি পিপলস লিবারেশন আর্মিকে বিশ্বমানের বাহিনীতে পরিণত করতে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেন। তিনি শিপইয়ার্ড ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে উদ্যোগ এখনও অব্যাহত আছে। চীনের জাহাজ নির্মাণ প্রকৌশল এরই মধ্যে পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছে।
সিএনএন জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট শি’র ওই পরিকল্পনা কাজে লেগেছে। ২০১৫ তে কাজ শুরু করে এখন বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী চীনের। আকার বাড়ানোর পর এখন সামরিক প্রযুক্তি আধুনিকায়নের কাজ করছে দেশটি।
এছাড়া, ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পিপলস লিবারেশন আর্মির নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নেন। সে বছর এপ্রিল মাসে দেশটি সবচেয়ে বড় নৌ মহড়া করে। ওই মহড়ায় ৪৮টি নৌবহর, কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান ও ১০ হাজার সেনা অংশ নেয়।
ওই সময় প্রেসিডেন্ট শি বলেছিলেন, শক্তিশালী নৌবাহিনী তৈরির কাজটি বর্তমান বিশ্বে ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকারোক্তিমূলক রিপোর্ট
ডিসেম্বরে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের নেভি, মেরিনস ও কোস্ট গার্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘ইতোমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী চীনের। সাবমেরিন, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, যুদ্ধবিমান, উভচর জাহাজ, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী সাবমেরিন এবং পোলার আইস ব্রেকার—উদ্বেগজনক গতিতে চীন নির্মাণ করে চলছে।’
রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের নৌবাহিনী মাত্র দুই দশকে তিন গুণের বেশি যুদ্ধজাহাজ বাড়িয়েছে। এর মধ্যে টাইপ ০৫৫ এর মতো বিধ্বংসী জাহাজ আছে। যাকে বিশ্লেষকরা বলেছেন মার্কিন টিকানডেরোগা-ক্লাস ক্রুজারের চাইতেও উন্নত।
আবার উপকূল আক্রমণের জন্য বিশেষভাবে তৈরি জাহাজের সাহায্যে চীন কাছাকাছি যেকোনো বিদেশি উপকূলে হাজার হাজার সেনা মোতায়েনের সক্ষমতাও অর্জন করেছে।
মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় শত্রু এখন চীন
মার্কিন নৌবাহিনী, মেরিন কোর ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর প্রধানরা চীনকে তাদের দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু বলে ঘোষণা করে বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক আগ্রাসী আচরণ ও আকাশচুম্বী পরিকল্পনা চীন বন্ধ না করলে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত নৌবাহিনীর মোকাবেলায় বেইজিংকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
মার্কিন নৌবাহিনীর প্রকাশিত ৩৬ পৃষ্ঠার এক কৌশলপত্রে বলা হয়, সমুদ্রে প্রতিনিয়ত চীন ও রাশিয়াকে মোকাবেলা করতে হয় মার্কিন বাহিনগুলোকে। মার্কিন মেরিন কমান্ডার জেনারেল ডেভিড বার্গার, নৌবাহিনীর অপারেশন্স প্রধান অ্যাডমিরাল মাইক গিলডে এবং উপকূলরক্ষী বাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল কার্ল শুলৎজ এই কৌশলপত্রে লিখেছেন।
তাদের মতে, দু’দেশই যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু কিন্তু চীন সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘ মেয়াদের কৌশলগত হুমকি হয়ে উঠছে।
তারা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছেন যে, চীনা নৌবাহিনী অনেক বেশি অত্যাধুনিক অস্ত্র উৎপাদন করছে এবং রাশিয়া অত্যন্ত আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে কাজ করছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধের প্রধান কারণ
ট্রাম্পের বিদায়ে বিশ্ব ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনায় হয়তো সাময়িক বিরতি আসবে। কিন্তু তার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শপথ নেয়ার পরপরই চীন শাসিত তাইওয়ান দ্বীপের কাছে দুই ডজনেরও বেশি যুদ্ধবিমান চালিয়েছে বেইজিং। পাশাপাশি, সমুদ্রসীমায় বিদেশি নৌযানে প্রয়োজনে গুলি চালানোর অনুমতি দিয়ে নতুন কোস্টগার্ড আইন পাস করেছে চীন।
ইতোমধ্যেই মার্কিন নৌবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠিয়েছে। এমন কর্মকাণ্ড সম্ভবত বাইডেন প্রশাসন ও বেইজিংয়ের মধ্যে আসন্ন বিরোধের ইঙ্গিত হতে পারে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত তিনটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমেরিকা-চীন বিরোধ সামনে বাড়তে পারে- দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান সংকট ও জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা।
দক্ষিণ চীন সাগর
দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ১৩ লাখ বর্গমাইল অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করে আসছে চীন। চীনের দাবি করা ওই অঞ্চল নিয়ে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই ও তাইওয়ানসহ আরও অনেক দেশেরও পাল্টা দাবি আছে। তা সত্ত্বেও ২০১৪ সাল থেকে ওই অঞ্চলে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সেগুলোকে শক্তিশালী মিসাইলসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের জন্য উপযোগী করেছে বেইজিং।
এদিকে, ওয়াশিংটন চীনের দাবির বিপক্ষে এবং ওই অঞ্চলের মিত্রদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নিয়মিতভাবে এই অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এবং সামরিক বিমান পাঠানো হয়। সম্প্রতি ওই অঞ্চলে দুই দেশেরই সামরিক মহড়া বেড়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের ওই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক কার্যকলাপ কমানোর সম্ভাবনা কম। গতবছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় বাইডেন নিজে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
তিনি জানান, সেসময় তিনি শি জিনপিংকে জানিয়েছিলেন যে, মার্কিন সেনারা চীনের স্বঘোষিত অঞ্চলে সংঘাত প্রতিরোধ করবে।
তাইওয়ান ইস্যু
মার্কিন-চীন উত্তেজনার মধ্যে তাইওয়ান ইস্যু আবারও প্রকট হয়েছে। কয়েকদিন আগে তাইওয়ানকে নিজের অংশ হিসেবে দাবি করে চীন। এমনকি দ্বীপ অঞ্চলটির কাছে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ ও বোমারু বিমান পাঠায়।
পরিপ্রেক্ষিতে বেইজিংকে তাইওয়ানের ওপর চাপ না দেওয়ার অনুরোধ করে ওয়াশিংটন। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা খাতে তারা সহযোগিতা দেবে।
এ ছাড়াও, জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের তিন দিন পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস তাইওয়ান ইস্যুতে চীনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা বেইজিংকে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে তার সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বন্ধ করার এবং পরিবর্তে তাইওয়ানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসার আহ্বান জানিয়েছি।’
এদিকে, তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই ‘যুদ্ধ’ বেঁধে যাবে বলে কঠোর ভাষায় হুশিয়ারি দিয়েছে চীন।
জাপান-যুক্তরাষ্ট্র মিত্রতা
টোকিওর কাছে ইয়োকোসুকা অঞ্চলে মার্কিন নৌবাহিনীর সপ্তম নৌবহরের সদর দপ্তর অবস্থিত। এটি ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে টহল দিয়ে থাকে। জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭২ সাল থেকে জাপান সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ পরিচালনা করে আসলেও, ওই অঞ্চলে নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবি করেছে চীন। গত বছর বেইজিং এই দাবিতে জোর দিতে দ্বীপপুঞ্জের আশপাশে কোস্টগার্ড জাহাজ মোতায়েন করে। কিন্তু ওই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে জাপানের দাবির পক্ষে বার বার সমর্থন দিয়েছে ওয়াশিংটন।
গত বুধবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগার সঙ্গে টেলিফোন আলাপে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, পূর্ব চীন সাগরের বিতর্কিত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জসহ পুরো জাপানকে রক্ষার ব্যাপারে তার প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে জানান, পূর্ব চীন সাগরের এ দ্বীপপুঞ্জ রক্ষার ক্ষেত্রে আমেরিকা আগে সম্পাদিত মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা চুক্তি অনুসরণ করবে। ওই চুক্তি অনুসারে, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে যদি জাপান কারো সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তবে আমেরিকাও জাপানের পক্ষে যুদ্ধ করবে।
হংকং নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র
শুক্রবার (৫ মার্চ) চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে ঘোষণা দেওয়া হয়, হংকং-এর নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হবে। কথিত ‘দেশপ্রেমিক’রা যেন হংকং এর শাসনক্ষমতায় থাকতে পারে তা নিশ্চিত করতেই এক পরিকল্পনা উন্মোচন করেছে চীনের শীর্ষ আইনপ্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীনের পরিকল্পনার সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একে হংকং-এর স্বায়ত্তশাসনের ওপর সরাসরি আঘাত বলে উল্লেখ করেছে তারা।
এ প্রসঙ্গে চীনের এনপিসির ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াং চেন দাবি করেন, হংকংয়ের ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দেখা গেছে যে সেখানে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় ফাঁক ফোকর রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এই ব্যবস্থায় থাকা ঝুঁকি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। যাতে করে কেবলমাত্র ‘দেশপ্রেমিকরাই’ অঞ্চলটির শাসন ক্ষমতায় আসতে পারে।
এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘চীনের এই প্রস্তাবিত আইন হংকং-এর স্বাধীনতা,স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর সরাসরি আঘাত। একইসঙ্গে দেশটির এই পদক্ষেপ হংকং-এর মৌলিক আইনেরও পরিপন্থী।’
প্রাইস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হংকং-এর মানুষের পাশে আছে। তারা কেবল তাদের অধিকারটাই চাচ্ছে,যা তাদের প্রাপ্য।’
এসডব্লিউ/এসএস/১০১০
আপনার মতামত জানানঃ