ধারাবাহিক লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি ২৫টি পাটকল। আশ্চর্যের বিষয়, এই পাটকল বন্ধের কারণে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হলেও কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই আছেন। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারী পাটকলের চাকা না ঘুরলেও প্রায় বসে বসেই বেতন নিচ্ছেন।
এদিকে, পেরিয়ে গেছে আট মাস। অথচ বন্ধ করার পর বিনিয়োগের অভাবে এখনও পাটকলগুলো চালু করতে পারেনি সরকার। শ্রমিকের পাওনা শোধ করতে পারেনি বিজেএমসি। মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিকেরা। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ইজারা দিয়ে বন্ধ পাটকল চালু করার পরিকল্পনা থাকলেও তা হয়নি।
পাওনা বুঝে পাননি পাঁচ হাজার শ্রমিক
এখনও অব্দি পাওনা বুঝে পাননি পাঁচ হাজার শ্রমিক। অন্তত ২০০ শ্রমিকের নামে এখনও মামলা ঝুলে আছে। বিষয়টি স্বীকার করে বিজেএমসি চেয়ারম্যান বলেন, পাওনা বুঝে না পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো। আইনি জটিলতার কারণে এই শ্রমিকরা তাদের পাওনা এখনও বুঝে পাচ্ছেন না।
জটিলতা বলতে বৈধ কাগজপত্রের অভাব। জাতীয় পরিচয়পত্রে বড় ধরনের ভুল। ব্যাংক হিসাবে জটিলতা। বিজেএমসি চেয়ারম্যান জানান, এরকম কিছু জটিলতা নিরসন করতে সময় লাগছে।
সরকারের ব্যর্থতা
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে ৭৭টি পাটকল রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়। একটা সময়ে এসে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে সেগুলো একে একে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার বন্ধ দুটি পাটকল চালু এবং বেসরকারীকরণ করা তিনটি পাটকল রাষ্ট্রীয় খাতে ফিরিয়ে এনে ফের চালু করে।
কিন্তু এক দশক পর ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে আওয়ামী লীগ সরকারই সর্বশেষ ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে। মিলগুলো আর রাষ্ট্রীয় খাতে চালু না হওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত।
সূত্র মতে, গত ৪৮ বছরে সরকারকে এ খাতে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে পাটশিল্পকে লাভজনক ও বেসরকারীকরণ বন্ধ করার কথা বলেছিল। পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। তবে লাভের লাভ কিছু হয়নি।
২০১০-১১ অর্থবছরেই ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মুনাফার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান হচ্ছে। গত ১১ বছরেই ৪ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। তার মধ্যে সর্বশেষ পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।
লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৫ পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা–অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন পাটকলগুলোতে বদলি শ্রমিক ছিলেন ২৩ হাজার ৮৪২ জন। দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যাও কম ছিল না, ৮ হাজার ৪৬৩ জন।
প্রসঙ্গত, বিজেএমসির আওতায় গত জুন পর্যন্ত ২৬টি পাটকলের মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন–জুট কারখানা।
শ্রমিকদের বেতন ভাতা নিয়ে অনিয়ম
পাটকলগুলোতে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারী রয়েছেন। ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত আট হাজার ৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন। অর্থ সংকটে তাদের অবসারভাতা পরিশোধ হয়নি। এছাড়া, তাদের পাওনাবাবদ এক হাজার ৩০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
সূত্র মতে, পাটকল বন্ধ করতে স্থায়ী শ্রমিকদের চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়নের সিদ্ধান্ত হলে একেকজন স্থায়ী শ্রমিক ১৪ লাখ থেকে ৫৪ লাখ টাকা পাবেন। শ্রমিকদের পাওনার ৫০ শতাংশ অর্থ নগদে ও বাকিটা তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র আকারে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে বলে জানা যায়।
এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে অবসরে যাওয়া ৮ হাজার ৯৫৬ শ্রমিকের পাশাপাশি বদলি শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। সে জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চায় পাট মন্ত্রণালয়।
বিজেএমসির তথ্যানুযায়ী, দৈনিক ভিত্তিতে পরিচালিত সিরাজগঞ্জের জাতীয়, খুলনার খালিশপুর ও দৌলতপুর এবং চট্টগ্রামের কেএফডি—এই চারটি পাটকলের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি গত আগস্টে পরিশোধ করা হয়। বাকি ২১ পাটকল শ্রমিকদের তাদের পাওনার অর্ধেক নগদে পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগ ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে।
পাওনার ৫০ শতাংশ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে পরিশোধের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে ৩ হাজার ৯৫ জন স্থায়ী শ্রমিক এখনো কোনো পাওনা বুঝে পাননি। বদলি শ্রমিকের পাওনা বাবদ ৩০৫ কোটি টাকা অর্থ বিভাগ এখনও পাশ করেনি।
লোকসানের দায় শ্রমিকের কাঁধে চাপানো!
বিজেএমসির কর্তারা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের পাটকলগুলো লোকসানের জন্য বরাবরই শ্রমিকদের বাড়তি মজুরিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় গত জুনে বলেছিল, বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি দুই হাজার ৭০০ টাকা। আর সরকারি পাটকলগুলোতে মজুরি আট হাজার ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এছাড়া, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে টিকে থাকতে কম দামে পাটপণ্য বিক্রি করতে হয়।
অবশ্য শ্রমিক নেতা মোজাম্মেল হক হাওলাদার এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, সরকারি পাটকলের যন্ত্রপাতি ৬০-৭০ বছরের পুরনো। ফলে পাটকলের উৎপাদনক্ষমতা ৪০-৪৫ শতাংশে নেমে যায়। তা ছাড়া পাটের মৌসুমে সুলভ মূল্যে কাঁচা পাট না কিনে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনাটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। এটি লোকসানের একটি বড় কারণ।
কাজ না করেই বেতন পাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
এদিকে পাটকল বন্ধ হওয়ার কারণে শ্রমিকেরা বেকার হলেও বিজেএমসির কর্মকর্তারা আগের মতোই আছেন। বর্তমান রাজধানীর দিলকুশার প্রধান কার্যালয় ও পাটকলগুলোতে ১ হাজার ৩৩ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। কর্মচারীর সংখ্যা ১ হাজার ৭৫২ জন। পাটকলগুলো উৎপাদনে না থাকায় অধিকাংশ কর্মকর্তারই হাতে বর্তমানে কোনো কাজ নেই। কিন্তু মাস শেষে বেতন ঠিকই পাচ্ছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বিজেএমসির চেয়ারম্যান বলেন, শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করাটা বিরাট কর্মযজ্ঞ। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতেই কাজ আছে। তবে পাটকলের উৎপাদন বন্ধ থাকায় আগের মতো পূর্ণোদ্যমে কাজ করতে হচ্ছে না। সব শ্রমিকের টাকা দেওয়া হলে কাজ কমে আসবে।
এদিকে, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পাটকল বন্ধ ও পুনরায় চালু করার বিষয়ে শুরু থেকেই সরকার দ্বিধান্বিতভাবে কাজ করছে। ফলে শ্রমিক ছাঁটাই করা হলেও বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়ে গেছেন। এতে করে সরকারের আর্থিক দায় বাড়ছে। আসলে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
বন্ধ পাটকল চালু করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ
গত রবিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বন্ধ ঘোষিত পাটকলগুলো লিজের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালুর সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ওই মিলগুলো চালু করা সম্ভব হলে অবসায়নকৃত শ্রমিকদের মধ্যে অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিকরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ পাবেন।
সূত্র মতে, আগের বৈঠকে বন্ধ হওয়া পাটকলগুলো পুনরায় চালু করার সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই সুপারিশের অগ্রগতি অবহিত করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বন্ধ ঘোষিত পাটকলগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম পুনরায় চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মিল চালুর জন্য লিজ বা ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মৌল নীতি ও কর্মপরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। এসংক্রান্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
বৈঠকে মিলগুলো চালুর পাশাপাশি শ্রমিকদের পাওনাদি দ্রুত পরিশোধের লক্ষ্যে শ্রমিকদের করা অনিষ্পন্ন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির সুপারিশ করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় অর্থনীতিতে পাট খাতের অবদান বাড়ছে। অথচ যখন এই খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সঠিক ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন ছিল, যখন এই খাতে লাভজনক হবার দ্বারপ্রান্তে ছিল, ওই মুহূর্তেই ভন্ধ হয়ে গেল পাটকলগুলো। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য মতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৪৩ দশমিক ৮৭ কোটি ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আর তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৫৩
আপনার মতামত জানানঃ