পশ্চিমাদেশগুলো আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ’তে ইরানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে বলে কয়েকদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। অবশেষে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সাথে ইরান সংলাপে বসার আগ্রহ প্রকাশ করলে পশ্চিমারা ইরানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। ইউরোপীয় কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল জাজিরা, রয়টার্স ও এপি এ তথ্য জানিয়েছে।
আল জাজিরা জানিয়েছে, পশ্চিমা শক্তিগুলি বৈশ্বিক পারমাণবিক সংস্থা ইরানকে সেন্সর করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে, কারণ ইরান তার কয়েকটি সাইটে পাওয়া ইউরেনিয়াম কণা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার যে বিতর্ক চলছে, তাতে সামান্য আশার আলো দেখা গিয়েছে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের নিউক্লিয়ার ওয়াচডগ সংগঠন জানিয়েছে, চুক্তির বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে তেহরান। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা কোনো রকম আলোচনাতেই যেতে চাইছিল না।
বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সির(আইএইএ) ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল গ্রসি ভিয়েনায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইরান তাদের সঙ্গে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ইরানের একাধিক অঞ্চলে ইউরেনিয়ামের মজুত আছে বলে আইএইএ-র বহুদিনের অভিযোগ। গত কয়েকমাসে তা আরো বাড়ানো হয়েছে বলেও অভিযোগ। কিন্তু ইরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন আইএইএ-র কোনো কর্মকর্তাকে ইরানে ঢুকতে দেওয়া হবে না এবং ওই অঞ্চলগুলিতে যেতে দেওয়া হবে না। বৃহস্পতিবার গ্রসি জানিয়েছেন, ইরান এ বিষয়ে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের অ্যাটোমিক ওয়াচডগের সঙ্গেও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ইরান। ইরানের সিদ্ধান্তের পিছনে জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের হাত আছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এই সপ্তাহেই জাতিসংঘে ইরানের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা ছিল এই তিনটি দেশের। কিন্তু আপাতত তা স্থগিত করা হয়েছে। তারপরেই সুর সামান্য হলেও নরম করলো ইরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা আলোচনার বিষয়ে আশাবাদী।
এদিকে আইএইএ’র মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি ইরানের সঙ্গে ‘টেকনিক্যাল’ বৈঠকে বসার জন্য আগামী এক মাস পর আবার ইরান সফরে আসবেন বলে ঘোষণা করেছেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সর্বশেষ এক বক্তব্যে তার দেশকে দায়ী করে আইএইএ’তে প্রস্তাব উত্থাপনের ব্যাপারে তিন ইউরোপীয় দেশকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এসব দেশ যেন আইএইএ’র সঙ্গে ইরানের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ক্ষতি না করে।
সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ‘কূটনীতিকে সুযোগ দেয়ার’ এবং রাফায়েল গ্রোসিকে তার প্রচেষ্টায় সফল হওয়ার সুযোগ দিতে তিন ইউরোপীয় দেশ ইরানবিরোধী প্রস্তাব উত্থাপন করেনি।
এদিকে রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, তিনি ইরানের কাছ থেকে ‘সদিচ্ছার’ প্রমাণ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ইরান ‘টেকনিক্যাল বৈঠক’ আয়োজনে সম্মত হয়েছে।
গত কিছুদিনে আলোচনার রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছিল ইরান। তারা জানিয়ে দিয়েছিল, আমেরিকা তাদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুললে পরমাণু চুক্তি নিয়ে তারা কোনও আলোচনায় বসবে না। দেশটিতে ইউরেনিয়ামের মজুত অনেকগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আইনসভায়। পাশাপাশি দেশের পরমাণু কেন্দ্রগুলিতে অ্যাটোমিক ওয়াচডগের নজরদারি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করার কথা ছিল জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের। জার্মানির বক্তব্য, ইরান যেভাবে এগোচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুত আলোচনায় বসা দরকার। তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নিতে হবে।
এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ‘প্রয়োজন মনে করলে’ ইরান ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ করবে বলে ঘোষণা দেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী হোসেইনি খামেনি।
তার দাবি, ‘দেশের প্রয়োজনে পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের বিষয়ে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ কারণে আমাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ২০ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং যত মাত্রা প্রয়োজন হবে তত মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হবে। উদাহরণস্বরূপ পামাণবিক প্রযুক্তি বা অন্য কোনো কাজে আমাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা শতকরা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে।’
আলোচনায় বসতে না চাওয়া, সর্বোচ্চ নেতার হুংকার বা পার্লামেন্টে ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়ানোর আইন পাসের মাধ্যমে পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর চাপ সষ্টি করতে চেয়েছিল ইরান। কিন্তু জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণের উদ্যেগের পরই সুর নরম করল দেশটি।
২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পাঁচ বিশ্ব পরাশক্তির মধ্যে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ত্রুটিপূর্ণ’, ‘একপেশে’, ‘এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই’ অভিযোগ তুলে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার পর চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলার ব্যাপারে ইরানও উদাসীন হয়ে পড়ে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের বিদায় এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরমাণু চুক্তিতে আবারও ফেরার ব্যাপারে আগ্রহী হয় ওয়াশিংটন ও তেহরান। অবশ্য চুক্তিতে কে আগে ফিরবে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক মতবিরোধ চলছিল। এর মধ্যে আলোচনায় ইরানের সম্মতি পরমাণু চুক্তিকে আবারও সক্রিয় করতে হয়তো সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। বাকি প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতে।
ইরানের মূল সমস্যা অবশ্য আমেরিকার সঙ্গে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। ওই প্রস্তাবে ইরানের ইউরেনিয়াম মজুত এবং পরমাণু অস্ত্র তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। ইরানও তাতে রাজি হয়েছিল। ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে শুধু বেরিয়ে আসেননি, ইরানের উপর নতুন করে একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তার পর থেকেই একের পর এক হুমকি দিয়েছে ইরান। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে হুমকি আরো বাড়িয়েছে ইরান। ফলে পরমাণু চুক্তি নিয়ে নতুন করে এক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। যদিও বাইডেন জানিয়েছেন, তিনি পরমাণু চুক্তি নিয়ে ফের আলোচনায় আগ্রহী।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৮৫৬
আপনার মতামত জানানঃ