রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি উল্টো রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সৃষ্ট দূরাবস্থার জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে দোষারোপ করেন। তবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে দোষারোপ করে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিকে অনভিপ্রেত, অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং রুচিবিবর্জিত বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের শেষে এদিকে উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে আজ বৃহস্পতিবার(০৪ মার্চ) ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদ। উপাচার্য ঢাকায় বসে মিথ্যাচার করছেন, শিক্ষামন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছেন, এমন অভিযোগ তুলেছে শিক্ষকদের সংগঠনটি।
উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ৪৫টি অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ১০তলা ভবন ও একটি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজে উপাচার্যের অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে ইউজিসির আরেকটি সরেজমিন তদন্ত কমিটি। এর জন্য উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওই কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর সংবাদ সম্মেলন
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার(০৪ মার্চ) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
সংবাদ সম্মেলন করে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ নিজের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এসব অভিযোগ ও ইউজিসির ‘এমন তদন্ত’ শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির আশ্রয়–প্রশ্রয় ও আশকারায় হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর আশকারায় পরিস্থিতি এ অবস্থায় এসেছে বলেও অভিযোগ করেন অধ্যাপক কলিমউল্লাহ।
তিনি বলেন, আমি আজ ঝেড়ে কেশে বলার জন্যই বসেছি এবং এ জন্য পরিণতি কী হবে, সেটি বিবেচনা করেই এসেছি। ইউজিসির দেওয়া প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে উপাচার্য বলেন, ইউজিসির প্রতিবেদন কেন এমন হয়েছে, তার জন্যও পরিপূর্ণভাবে দায়দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রীর। তার পরামর্শে তদন্ত কমিটি এমন আচরণ করেছে বলে অভিযোগ কলিমউল্লাহর।
সংবাদ সম্মেলনে ইউজিসির মর্যাদা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি মনে করেন, এসবের পেছনে কুমিল্লা ও চাঁদপুরের রাজনীতি আছে। কারণ তাদের দুজনের (শিক্ষামন্ত্রী ও উপাচার্যের) বাড়ি একই অঞ্চলে।
সংবাদ সম্মেলনে নিজে ক্যাম্পাসে গরহাজির থাকা, প্রকল্পের অনিয়মের অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে করা প্রশ্নের জবাব দেন নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন
এদিকে একইদিনে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ তার বিরুদ্ধে পরিচালিত তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) শিক্ষামন্ত্রী প্রভাবিত করার যে অভিযোগ তুলেছেন- তা অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়েরের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইউজিসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিধায় এ প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ে মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে নানা ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে অনুরোধ জানানো হয়। ইউজিসি তাদের নিয়ম অনুযায়ী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত সম্পন্ন করে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায়। ইউজিসি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাই এ প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ে মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর অভিযোগ অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ ছাড়া অধ্যাপক কলিমউল্লাহ শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য রেখেছেন, যা নিতান্তই অনভিপ্রেত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, অধ্যাপক কলিমউল্লাহ এসবের বাইরেও শিক্ষামন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার কথা উল্লেখ করে রাজনীতিকে জড়িয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন, যার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কোনো বিষয়ের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা না থাকায় এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে। এ ছাড়া নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে যেসব বক্তব্য রেখেছেন, সেসব বিষয়েও এ মুহূর্তে মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে। কারণ, তার বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন সম্প্রতি ইউজিসি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতিসংক্রান্ত আরেকটি অভিযোগের তদন্ত চলমান। এ অবস্থায় কলিমউল্লাহর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া অন্যান্য সব বক্তব্য সম্পর্কে মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন প্রাপ্তি ও বিবেচনার পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় বক্তব্য উপস্থাপন করবে।
ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা
এদিকে ঢাকায় বসে মিথ্যাচার, শিক্ষামন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার অভিযোগ এনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে বঙ্গবন্ধু পরিষদ।
ভিসির ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়া দেয় সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা অমান্য করে ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক অনুপস্থিতি, ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনা ধামাচাপা দেয়া, ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে জনবল নিয়োগ, শিক্ষক ও জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম, নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ভিসি হয়েও অনুপস্থিত থাকা, নিরাপত্তাহীন ক্যাম্পাস, ইচ্ছামতো পদোন্নতি, আইন লঙ্ঘন করে একাডেমিক প্রশাসনিক পদ দখল ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় নীতিমালা লঙ্ঘন, ভিসি’র অননুমোদিত ও অনিয়মতান্ত্রিক ফাউন্ডেশন ট্রেইনিং, ঢাকাস্থ লিয়াজোঁ অফিসে অতিরিক্ত খরচ, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, চরম শিক্ষক সংকটসহ নানান অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দেয়ায় আজ তিনি ঢাকায় বসে মিথ্যাচার করেছেন।
মশিউর রহমান বলেন, উপাচার্য হিসেবে যোগদান করার পর থেকে আজকে ১৩৫৬ দিন অতিবাহিত। এর মধ্যে তিনি ১১১৯ দিনই ক্যাম্পাসে না এসে ঢাকায় ছিলেন। অথচ উপাচার্য ঢাকায় বসে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০-২২ ঘণ্টা কাজ করেন বলে মিথ্যাচার করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষে অরও বলা হয়, আমরা তার দায়িত্ব নেয়ার দুই বছর পর অভিযোগ করেছি। কিন্তু তিনি সংবাদ সম্মেলনে আগের ভিসিকে দোষ দিচ্ছেন। তাহলে দুই বছরে তিনি কী করলেন? তার সময়েই তো নকশা পরিবর্তনসহ যত দুর্নীতি হয়েছে। তার নিকটাত্মীয়দের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভরিয়ে ফেলেছেন। নিজের কাছের লোক দিয়ে যতসব অনিয়ম করেই চলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বেরোবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ভিসি সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রীকে আক্রমণ করে কথা বলেছেন। স্পিকারসহ সরকারের কর্তাদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এমনকি ইউজিসির বিষয়েও বাজে মন্তব্য করেছেন। সরকারের উন্নয়নসহ সবকিছুর বিষয়েই তিনি বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য করেছেন। তাই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হলো। অতিসত্বর এসব মন্তব্যের জন্য ক্ষমা না চাইলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আমরা বাধ্য হব।
ভিসির মদদে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে এবং ভিসি নিজেও যেভাবে আইন অমান্য করে চলছেন, তাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নসহ পড়াশোনার পরিবেশ স্থবির হয়ে পড়েছে। আমরা চাই দুর্নীতিবাজ উপাচার্যের শাস্তিসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যাহার করা হোক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ