বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব কায়দায় এবং বিস্তৃত পরিসরে জায়গা দখল চলছে, তার মর্মান্তিক শিকার নদ-নদীগুলো। ঢাকার নদ-নদী এর প্রবল শিকার। টঙ্গীর তুরাগ নদের অবস্থা এই দিক থেকে শোচনীয়। উচ্ছেদের দেড় বছরের মধ্যে আবার দখল হতে শুরু করলো তুরাগ তীর, নদীর তীরবর্তী জায়গার মালিকগনের সাথে তিন সরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে দখলদারীরা এই দখল অব্যাগত রেখেছে। আব্দুল্লাপুর রেলগেইট থেকে গাবতলি পর্যন্ত বেড়িবাঁধসহ তুরাগ তীরে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা প্রায় এক হাজার একশ জন।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে উচ্চ আদালত বলেছিলেন, নদী দখল-উচ্ছেদ নিয়ে কানামাছি খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। নদী দখলের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের কঠিন অবস্থানের পরও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। নানামুখী চাপে উচ্ছেদ অভিযান আশানুরূপ এগোয়নি। দখলমুক্ত করার পর অনেক জায়গা আবারও অবৈধ দখলে চলে গেছে। সেখানে অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত তুরাগ তীরে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ৮০ শতাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিটিএ। সংস্থাটি বলছে, নদ-নদীর সীমানা পিলার ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প চলমান রয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে, দখলমুক্ত করার পর স্থায়ী সীমানা পিলার অতিক্রম করে আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে তুরাগ। টঙ্গী সেতুর পশ্চিম পাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড এর জায়গা দখল করে মাছের আড়ত বসিয়ে তুরাগ দখলে গেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৪৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এরপর টঙ্গী রেলওয়ে থেকে গাবতলী ব্রিজ পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ও তুরাগ তীর ঘেঁষে ২০ কিলোমিটারের মধ্যের এর একই কায়দায় প্রায় ১১ শতাধিক কাচাঁ পাকা ঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, গাড়ির স্ট্যান্ড, স্থায়ী ভবনসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান করে তুরাগ দখলে রেখেছে প্রভাশালী মহল। এরমধ্যে তুরাগ তীরে প্রায় ৮টি প্রতিষ্ঠানকে সংযোগ সড়ক ব্যবহারের জন্য জমি লীজ দেয়ার কথা জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বারবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেও তুরাগ নদ দখল ও নদের প্রবাহ বজায় রাখতে না পারার কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলেছেন, বিআইডব্লিউটিএ’র লোকজন হঠাৎ হঠাৎ এসে উচ্ছেদ করে যায়, কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো তদারকি করে না। তাই উচ্ছেদের পর আবারো দখল হয়ে যাচ্ছে নদীতীর।
জানতে চাইলে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন গবেষক ড. ফাতেমা রোকশানা বলেন, ২০১৫ সালে ঢাকার নদীগুলো নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়। তখন তুরাগের ওয়াকওয়ে ও সিঁড়ির ওপর ময়লার স্তূপ দেখা গেছে। এখনো একই অবস্থা। যেখানে ‘ময়লা ফেলা যাবে না’ সাইনবোর্ড লেখা থাকে, মানুষ সেখানেই ময়লা বেশি ফেলে। ওয়াকওয়ে বা সিঁড়ির ওপর ময়লা ফেললে ক্ষতিটা হয় বেশি। আবর্জনাটা তখন পচতে সময় নেয় ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত করে ফেলে। সরকারের ভালো ও প্রশংসনীয় পরিকল্পনাও সঠিক বাস্তবায়ন ও তদারকির অভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজধানীর গাবতলীর কাছে পালপাড়া ঘাট থেকে শুরু করে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরলে প্রথমেই পালপাড়া ঘাটে দেখা যায় বিশাল এক পাইপের মাধ্যমে কীভাবে ড্রেনের ময়লা পানি ও বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। পানি এখানে এতটাই দূষিত যে, তীরের পাশের ইটগুলো পর্যন্ত কালো রঙ ধারণ করেছে। পাশাপাশি দুর্গন্ধের তীব্রতার কথা না বললেই নয়। আর একটু এগোতেই দেখা মেলে নদীর পাশে লাউ শাক, সিম এগুলোর সারি সারি মাচা। এগুলো খাওয়া কতটা স্বাস্থ্যকর তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।
বেশ কয়েকজন নারীকে দেখা গেল এ কালো পানি দিয়েই কাপড় ধুচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো শিশুরা এ নদীর আশেপাশে চরম অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খেলাধুলা করছে, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির নির্দেশক। প্রতিনিয়ত বালুবাহী কার্গো থেকে বিপুল পরিমাণ তেল-বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে। এর একটু সামনে বেদের টেক ঘাটের পাশে বিশাল বিশাল ময়লার স্তূপ। নৌকার মাঝিসহ স্থানীয়রা জানালেন, এর জন্য সাধারণ মানুষই দায়ী। কাউন্দিয়া ঘাট ও তার আশেপাশে নদীর তীরে এক সঙ্গে চলছে মানুষ এবং ছোট ছোট চতুষ্পদ জন্তুগুলোর নিত্য আনাগোনা। মানুষ এখানে পায়ে হেঁটে নৌকায় উঠছে আর ওরা নদীর পাড়ের ময়লার স্তূপে দল বেঁধে খাবার খুঁজছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হক বলছেন, বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তারা যে কাউকে জেটি করার অনুমতি দিচ্ছে। এসময় তিনি আরও জানান, এরইমধ্যে উচ্ছেদের তালিকা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। আবারও উচ্ছেদ শুরু হবে।
প্রসঙ্গত, তুরাগ নদের টঙ্গী ও ঢাকা প্রান্তে হাঁটার রাস্তা, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে, কিউ ওয়াল, তীর সংরক্ষণ এবং আরসিসি সিঁড়িসহ পাঁচ ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এ ব্যয়ে তুরাগ নদের টঙ্গী প্রান্তে হাঁটার রাস্তা ১২৯০ মিটার, তীর সংরক্ষণ ১২৯০ মিটার, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে ৬৭৫ মিটার, কিউ ওয়াল ৩৩৫ মিটার এবং ১৫টি আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে তুরাগের ঢাকা প্রান্তে নির্মাণ করা হয় হাঁটার রাস্তা ২০৯০ মিটার, তীর সংরক্ষণ ২০৯০ মিটার, পাইলের ওপর ওয়াকওয়ে ৬২৫ মিটার এবং আরসিসি সিঁড়ি ১৮টি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান দিয়ে নদী দখল বন্ধ করা যাবে না। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্রের সম্পদ যারা দখল করছে, তারা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের কোনভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। শুধু উচ্ছেদ করলেই হবে না, উচ্ছেদকৃত জায়গা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নদীর সীমানা নির্ধারণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। নদী পারের দখলমুক্ত জমি যেন কোনভাবেই পুনর্দখল না হয় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ