নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ।
বায়ু ও বিষাক্ত বর্জ্যের দূষণের কারণে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী একটি গবেষণায় এসব তথ্য জানান। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
মঙ্গলবার (১৭ মে) প্রকাশিত প্রতিবেদনে তারা বলছেন, শিল্পপণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণের ফলে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বায়ু দূষণ সংক্রান্ত কারণে মৃত্যু ৭ শতাংশ বেড়েছে।
পিওর আর্থ নামে দূষণ নিয়ে কাজ করা একটি অলাভজনক সংগঠনের প্রধান ও গবেষণার সহলেখক রিচার্ড ফুলার বলছেন, ‘আমরা একটি গরম পাত্রে বসে আছি এবং ধীরে ধীরে জ্বলছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভির মতো পরিবেশ দূষণে অত গুরুত্ব দিচ্ছি না।’
২০১৭ সালে একই গবেষণার একটি প্রাথমিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, দূষণে প্রতিবছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অর্থাৎ ছয়জনে একজনের মৃত্যুর কারণ দূষণ। এতে করে প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। অথচ তুলনায় দেখা যাচ্ছে, করোনা মহামারিতে এখন পর্যন্ত ৬৭ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
সর্বশেষ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ল্যানচেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিসের ২০১৯ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিস নামে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের চলমান গবেষণায় বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি ও বায়ুদূষণের কারণে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সেই হিসাব করা হয়।
প্রথাগত দূষণে মৃত্যু কমলেও এখনো সেটা আফ্রিকা ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রধান সমস্যা হিসেবে থেকে গেছে। আফ্রিকার তিন দেশ চাদ, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, নাইজারে এখনো দূষণ সংক্রান্ত মৃত্যুর বড় কারণ দূষিত বায়ু, মাটি ও ঘরের ভেতরের দূষিত বায়ু।
‘আমরা একটি গরম পাত্রে বসে আছি এবং ধীরে ধীরে জ্বলছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভির মতো পরিবেশ দূষণে অত গুরুত্ব দিচ্ছি না।’
নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অন হেলথ অ্যান্ড পলিউশনের নির্বাহী পরিচালক ও গবেষণা নিবন্ধের সহলেখক রাকায়েল কুপকা জানাচ্ছেন, ভারী ধাতু, কৃষি রাসায়নিক পদার্থ ও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমনের সংস্পর্শে আসার কারণে মৃত্যু ২০০০ সালের তুলনায় ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
তবে ঘরের বাইরের বায়ু দূষণের প্রসঙ্গ আসলে ব্যাংকক, চীন ও মেক্সিকো সিটির মতো বড় বড় শহরগুলোর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ছোট শহরগুলোতে দূষণের মাত্রা বাড়ছেই।
গবেষণা অনুযায়ী, দূষণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে এমন ১০টি দেশের বেশির ভাগ আফ্রিকার। পরিবেশ দূষণে সর্বাধিক মৃত্যু দেখা দেশগুলো যথাক্রমে চাদ, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, নাইজার, সোলোমন দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ আফ্রিকা, উত্তর কোরিয়া, লেসোথো, বুলগেরিয়া, বুরকিনা ফাসো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণ বিশ্বে বছরে ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটায়। ধূমপান ও খারাপ খাদ্যের মতো একই মাত্রায় ক্ষতি করে বায়ুদূষণ।
বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে৷
ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হচ্ছে মারত্মক বায়ুদূষণ। এর ফলে ফুসফুস হৃদযন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ তৈরিকারী উপাদানের উপস্থিতি কমাতে হবে। সেকারণেই বায়ুর মান নিয়ে এই নতুন নির্দেশনা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, শিল্প কলকারখানাগুলি যাতে আর্থিক চাপের মুখে না পড়ে তাই পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আইনকানুনকে উপেক্ষা করা হয়৷ বেশির ভাগ কলকারখানাই মানসম্মত নয়৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাতাসের গুণগত মান রক্ষা করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে৷ যেমন বলা হয়েছে, কলকারখানাগুলিতে সূক্ষ্ম ধুলিকণা প্রতিরোধী ফিল্টার লাগাতে হবে৷ তাপ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে কয়লার পরিবর্তে গ্যাসের ব্যবহার করতে হবে৷ গাড়িতে ক্যাটালিটিক কনভার্টার ব্যবহার করতে হবে৷
এক্ষেত্রে আর্থিক সুযোগ সুবিধা মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে৷ যেমন পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষ করের প্রবর্তন করা যেতে পারে৷ যারা বায়ু দূষণকারী মেশিন ও কারিগরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, তাদের ওপর এই কর আরোপ করা হলে বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধ জেগে উঠতে পারে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৯
আপনার মতামত জানানঃ