কবি’র ভাষায়, পৃথিবীই সবেচেয়ে বড় কারাগার যেখানে জন্মানোর অপরাধে যাবজ্জীবন কারাভোগ করতে হয়। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ, এতকিছু বুঝি না, তারা পৃথিবীতেই গড়ে তুলেছি অজস্র কারাগার। আর এসব কারাগার গড়ে তোলার পেছনে আমাদের একটাই যুক্তি— পৃথিবী অপরাধী মুক্ত হোক, হোক কারাগার হবার দোষ থেকে তার মুক্তি। এসবের মাঝেও কেউ কেউ থাকেন, যারা স্বাধীনভাবে চলাটাকেই মুক্তি বলে মনে করেন। আর যদি হয় সে কারাভোগী কোনো আসামি তখন কথাটা হাস্যকর শোনালেও এমনটিই হয়েছে আশ্চর্য এই পৃথিবীতে।
তার নাম জো লিগন। বয়স এখন ৮৩। ১৫ বছর বয়সে আরো দুই বন্ধুর সঙ্গে ফিলাডেলফিয়ার কারাগারে যান যাবজ্জীবনের শাস্তি মাথায় নিয়ে। কারাগারে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলার যেমন প্রশ্নই ওঠে না, সেখানে কোনো দাগী আসামিও থাকতে রাজি হবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লিগন দীর্ঘ একটা সময় কারাভোগ করলেও একটা সময় যাবজ্জীবন শাস্তি থেকে প্যারোলে মুক্তি পান। সালটা ১৯৭০। পেনসিলভানিয়ার গভর্নর লিগন ও তার সঙ্গীদের ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং আশ্চর্জজনকভাবে দুজন সেই অফার নিলেও লিগন তা প্রত্যাখান করেন। এরপরেও তার নিকট আরেকবার প্রস্তাব আসে। ২০১৭ তে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট তাকে আরও একবার প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি সেটিও প্রত্যাখান করেন।
২০১৬ সালে মিলার অ্যালাবামার ২০১২ সালের কেস, যেখানে মিলারকে প্যারোলের শর্ত ছাড়াই যাবজ্জীবন দেয়া হয় তা অন্যায্য ছিল বলে ঘোষণা দেয় কোর্ট। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে কিশোর অপরাধের শাস্তি হিসেবে আজীবন সাজা অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়। ফলে লিগনের মুক্তিতে আর কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল না। তার সামনে মুক্তির অনেক পথ খুলে যায়। ফলে লিগনেরও ৩৫ বছরের সাজা মওকুফ হয় এবং ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে থাকায় তিনি প্যারোলে মুক্তির উপযুক্ত হন। কিন্তু প্যারোলে মুক্তি তাকে স্বাধীনতা দিবেনা, থাকতে হবে নজরদারির মধ্যে; তাই সেই প্রস্তাব আবারও প্রত্যাখান করেন লিগন। মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য থেকে গেলেন কারাগারেই।
আশ্চর্য এই মানুষটি দীর্ঘ ৬৮ বছরের কারাভোগ শেষে পেনসিলভানিয়ার জেল থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বৃদ্ধ বয়সে ছাড়া পান। পেনসিলভানিয়ার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রিগনকে বিবেচনা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বয়স্ক ও দীর্ঘদিন জেলে থাকা বন্দি হিসেবে।
জো লিগন ডাকাতি ও খুনের মামলায় ১৯৫৩ সালে যখন কারাগারে ঢোকেন তখন তার বয়স সবে ১৫। আর ২০২১ সালে এসে যখন কারাগার থেকে মুক্তি পান, তখন বয়স ৮৩। কৈশোর ফেলে যৌবন, যৌবন শেষে বৃদ্ধ প্রায় পুরো জীবনটাই কেটে গেছে বদ্ধ জেলখানায়। পৃথিবীর মুক্ত আলো-বাতাস ফিরে পেতে জীবন থেকে একে একে হারিয়ে গেছে ৬৮ বছর। তবুও খুশি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের জো লিগন।
নতুন জগতে প্রবেশ করতে পারার অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘সুন্দর, খুবই সুন্দর। আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। আর শিশু নই। আমি কি শুধু একজন বড় মানুষই, একজন বৃদ্ধও। প্রতিদিন আরও বৃদ্ধ হচ্ছি।’
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ফিলাডেলফিয়ার রাস্তায় আরও দু চারজন ছেলের সঙ্গে এক হয়ে মাতলামি এবং ডাকাতি করতে গেলে বাধা দেয়ায় তারা কিছু লোককে ছুরিকাঘাত করেন। এদের মধ্যে ছয়জন গুরুতর আহত এবং দুজন নিহত হয় বলে অভিযোগ আনেন ফিলাডেলফিয়ার তদন্ত কর্মকর্তা চার্লস পিটস এবং জ্যাকসন হ্যাম। এই অপরাধের দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
শুনানিতে যেখানে লিগনকে একটি ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারের জন্য দায়ী করা হয়েছে এবং লিগন সেই আট ব্যক্তির মধ্যে অন্তত একজনকে ছুরিকাঘাত করার কথা স্বীকার করেছেন, সেখানে লিগনের আইনজীবি ব্র্যাডলি ব্রিজ দাবি করেছেন যে লিগন কোনোদিন কাউকে খুন করেননি।
লিগনের আইনজীবী ব্র্যাডলি ব্রিজ বলেন, ১৯৫৩ সালে এই শিশুরা যে অপরাধ করেছে তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ৬৮ বছর পর কারাগার থেকে বেরিয়ে আসা জো লিগন এখন ৮৩ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ। তিনি অনেক বড় হয়েছেন, বদলে গেছেন। সমাজের জন্য তিনি আর হুমকি নন। যে ক্ষতি তিনি করেছেন তা সমাজকে পুরোপুরি শোধ করে দিয়েছেন। জীবনের বাকি বছরগুলো স্বাধীনভাবে কাটাতে পারবেন এটাই তার জন্য উপযুক্ত।’
১৫ বছর ধরে লিগনের প্রতিনিধিত্ব করা আইনজীবি ব্রিজ জোর দিয়ে বলেন যে, কিশোর হিসেবে তখন লিগনকে যে সাজা দেয়া হয় তা ছিল অসাংবিধানিক। পেনসিলভানিয়া ইন্টারমিডিয়েট অ্যাপিলেট কোর্টে একবার শুনানি দিয়ে ব্যর্থ হলেও, পরে ব্রিজ লিগনের কেসকে ইউএস ফেডারেল কোর্টে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। ব্রিজ ২০২০ সালের নভেম্বরে লিগনের মামলাটি জিতেন এবং এর ফলেই ২০২১ সালে এসে লিগন পান সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
মুক্তি যেহেতু পেয়েই গেছেন, তাই এখন লিগনকে সমাজে সুন্দরভাবে বসবাস করার ও মানিয়ে নেয়ার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হচ্ছে। ফিলাডেলফিয়া ভিত্তিক সংগঠন ইয়ুথ সেন্টেন্সিং অ্যান্ড রিএন্টারিং এর একজন সাবেক কর্মী জন পেস লিগনকে এই কাজটি করতে সাহায্য করছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ
আপনার মতামত জানানঃ