সাভারের আশুলিয়ায় ইয়ারপুর ইউনিয়নে হাজি ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার মূল অভিযুক্ত ওই স্কুলেরই দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু ওই এলাকায় “জিতু বাহিনী” নামে একটি কিশোর গ্যাং-এর প্রধান। সে এখনো আটক হয়নি। উল্টো সে এখন অন্য আরো কয়েকজন শিক্ষককে হুমকি দিচ্ছে।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে জিতুর বাবা আকরাম হাজি কোনো পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে দাপট দেখাচ্ছেন অনেক দিন ধরে। আর এর মূলে আছেন ইয়ারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান শাহেদ। মজিবর রহমানের সহযোগী হলেন জিতুর বাবা আকরাম হাজি। একই সঙ্গে জিতু স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা কাব্য এর সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
জানা গেছে তাদের সহযোগিতায়ই জিতু কয়েক বছর ধরে এই কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মিছিল মিটিং-এ তার গ্যাং নিয়ে অংশ সে নিয়মিত অংশ নেয়। তারা তাকে নানা কাজে ব্যবহারও করে। তবে আওয়ামী লীগ নেতা মজিবর রহমান শাহেদ দাবি করেন, তিনি জিতু বা তার বাবাকে চেনেন না। তিনি বলেন,”একজন শিক্ষককে হত্যা জঘন্য নিন্দনীয় কাজ। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
জিতু আগে মাদ্রাসায় পড়ত। সেখানে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় তাকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্থানীয়রা জানান, এই জিতু বাহিনী স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের ইভটিজিংসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিলো। তাদের গ্রুপে ৩০-৪০ জন কিশোর আছে। ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতো না। শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার তার এই অপকর্মের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কারণেই তাকে হত্যা করা হয়।
কিশোর গ্যাং-এর পেছনে রাজনৈতিক নেতা
শুধু এই জিতু বাহিনী নয় আরো অনেক কিশোর গ্যাং-এর নেপথ্যেই আছে রাজনৈতিক গডফাদার। ঢাকাসহ সারাদেশে এপর্যন্ত যেসব কিশোর গ্যাং আলোচনায় এসেছে তাদের অধিকাংশের নেপথ্যে আছে স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতারা। তাই পুলিশ একটি গ্যাং ধরে তো আরেকটি গ্যাং গজিয়ে ওঠে। আর এই গডফাদাররা তাদের নানা অপরাধ কর্মে কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করে।
আশুলিয়া যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবুল হোসেন ওরফে আপনের ছত্রছায়ায় সেখানে আছে আরেকটি কিশোর গ্যাং। ওই গ্যাং ২০২০ সালে সবুজ নামে এক কিশোরকে অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যা করে। ওই ঘটনায় জড়িত কিশোরদের আটকের পর আবুলের নাম প্রকাশ হয়। পরে আবুল গ্রেপ্তার হলে তিনি স্বীকার করেন যে নিজের প্রভাব ও শক্তি দেখাতে এবং ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেতই তিনি কিশোর গ্যাং তৈরি করেন।
আশুলিয়ার আরেক যুবলীগ নেতা জোবায়ের আহমেদ ইমনেরও আছে কিশোর গ্যাং। ইন্টারনেট ও ডিস ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে তিনি এই কিশোর গ্যাং-কে ব্যবহার করেন।
সাভারে ২০২০ সালে কিশোর গ্যাং-এর হাতে নিহত হন স্কুল ছাত্রী নীলা রায়। ওই কিশোর গ্যাং-এর মূল নেতা মো. সাকিব হোসেন। তার বাবা সাভার পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম শিরু। তিনি তার ছেলে সাকিবকে দিয়ে কিশোর গ্যাংটি তৈরি করেছিলো মাদক ব্যবসাসহ আরো নানা অবৈধ কাজ পরিচালনার জন্য। মিজানুর রহমান নামে এক কিশোরকে দিয়ে গ্যাংটি পরিচালানা করা হতো। গ্যাং-এ ২০-৩০ জন সদস্য ছিল।
শুধু ঢাকা শহরেই ৭০-৭৫টি কিশোর গ্যাং-এর কথা বলা হচ্ছে। এদের আলাদা নাম ও পরিচিতি আছে। আর সারা দেশে এই গ্যাং-এর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর গ্যাং-এর অন্য বাস্তবতা থাকলেও এখন যা পরিস্থিতি তাতে রাজনৈতি নেতা এবং প্রভাবশালীরা তাদের দখলদারিত্ব, চঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কর্মে কিশোর গ্যাংগুলোকে ব্যবহার করে।
আর কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা যখন দেখে তাদেরকে ব্যবহারকারীরা গণ্যমান্য, পুলিশসহ প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করেন তখন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের বয়স কম হওয়ায় তারা পরিণিতির কথা চিন্তা না করে যে কোনো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এটা এখন আমাদের একটি বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।
যারা নেপথ্যে থাকেন তাদের দেশে প্রচলিত আইনে ধরার সুযোগ খুব কম। তাই এই কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে নতুন কোনো আইন অথবা পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
কী বলছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী?
কিশোর গ্যাং নিয়ে কাজ করা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানোর পরও তাদের সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। একই এলাকায় একটি গ্রুপকে আটক করলে আরেকটি গ্রুপ তৈরি হয়।
তারা বলেন, “এর পেছনে ইন্টারনেট সংস্কৃতির প্রভাব থাকলে মূল কারণ হলো স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা। তারাই তাদের স্বার্থে নতুন নতুন কিশোর গ্যাং তৈরি করে।”
ডিএমডির গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার মশিউর রহমান বলে,”গুলশান ও ভাটারা এলাকায় কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং সদস্যদের আটকের পর আমরা তাদের কাছ থেকেই জানতে পারি কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করেন। নির্মাণ কাজে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলার কাজে তাদের ব্যবহার করা হয়। এরাই কিশোরদের অস্ত্র দেয়। আর এই অস্ত্রের উৎস খুঁজতে গিয়ে আমরা যাশোরের এক ছাত্রলীগ নেতাকেও গ্রেপ্তার করেছি।”
তিনি জানান, “কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের বলে বলীয়ান হয়ে নিজেরাও স্বাধীনভাবেও অপরাধ করে। ফলে দেখা যায় একটি অপরাধে ৩০-৪০ জন কিশোর জড়িয়ে পড়ে। এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ