চিকিৎসা একটি মহান পেশা। সেজন্য চিকিৎসকদের দায়িত্বশীলতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। অনেক ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের সামান্য অবহেলা, অসচেতনতা কিংবা দায়িত্বহীনতা ডেকে আনতে পারে মারাত্মক পরিণতি। তাই চিকিৎসাসেবার প্রতিটি স্তরে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র লেখার সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-বিধান ও গাইডলাইন রয়েছে। অমান্য করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় বটেই, উন্নয়নশীল দেশেও ব্যবস্থাপত্রে রোগ ও ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার বিধান অন্যতম। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লেখার ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানছেন না। শুধু তাই নয়, সামান্য অসুখেও অ্যান্টিবায়োটিকের মতো সংবেদনশীল ওষুধ দেয়া হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই। এমন নানা ত্রুটি ও দুর্বলতা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে।
টানা কয়েকদিনের জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট ও কাশি নিয়ে সরকারি একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন রাজশাহীর গৃহবধূ শবনম (ছদ্মনাম)। রোগীকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ব্যবস্থাপত্র দেন চিকিৎসক। ওষুধের দীর্ঘ তালিকাসংবলিত ব্যবস্থাপত্রে স্থান পায় অ্যান্টিবায়োটিকও। যদিও ব্যবস্থাপত্রে সঠিকভাবে রোগের বিবরণ উল্লেখ করেননি চিকিৎসক। ওষুধের কোনটি কী কারণে দেয়া হয়েছে, রোগীকে তা-ও জানানো হয়নি। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে ঘটছে এ ঘটনা। অথচ অ্যান্টিবায়োটিকের এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগের কারণে ক্রমেই বাড়ছে নানা জটিলতা।
জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের একটি সংখ্যায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বছরে কমপক্ষে ২ লাখ ১৪ হাজার নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে যথেষ্ট ভয়াবহ, তা বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত কয়েক বছরে কিছু বিশেষায়িত হাসপাতালের আইসিইউতে আসা ২৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে সংক্রমণে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। বাংলাদেশে সার্বিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার ও নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণ বাড়ছে ভয়ংকরভাবে। হতাশার বিষয় হলো, দেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কার্যকর ও যুগোপযোগী নীতিমালাও নেই।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, এরই মধ্যে রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকের বড় চারটি ধরন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে সেফেপিম নামক রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, ৪৯ শতাংশ। এছাড়া লিনেজোলিড ২৩ শতাংশ, টিজেসাইলিন ২০ শতাংশ ও কোলেস্টিন ৮ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে মেডিসিন, সার্জারি, আইসিইউ, বার্ন ও অন্যান্য ইউনিটে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমেই কমে আসছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। হ্রাস পেয়েছে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতাও। এ অবস্থায় রোগীদের ওপর রিজার্ভ (প্রচলিত নয় এমন) অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ বেড়ে গেছে। এতে দ্রুত কার্যক্ষমতা হারাতে বসেছে বাকি সব ধরনের ওষুধ।
চিকিৎসকদের বক্তব্য হলো, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে একজন চিকিৎসক দিনে সর্বোচ্চ ৩০ জন রোগী দেখতে পারেন। কিন্তু কোনো কোনো সময় তাকে শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়। সব হাসপাতালে পরীক্ষার সুযোগ থাকে না। এছাড়া সম্পদ ও লোকবলের সংকট রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা সঠিকভাবে তার সমস্যা বলতে পারে না। আর পরীক্ষা ছাড়া রোগের সঠিক নির্ণয় সম্ভব নয়। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এটিও অস্বীকারের উপায় নেই। এক্ষেত্রে রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ গাইডলাইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অ্যান্টিবায়োটিক হলো এক অর্থে ‘মিরাকল ড্রাগ’। কিন্তু এর যথেচ্ছ ও ভুল ব্যবহারে এই ওষুধের কার্যকারিতা দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক-পূর্ব যুগে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত যাতে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা না হয়, এ বিষয়টি সবাইকে কঠোরভাবে মানতে হবে।
প্রেসক্রিপশনে রোগীর নাম, বয়স, তারিখ এবং ক্ষেত্রবিশেষে শিশুদের ওজনও লিখতে হয়। বাম দিকে রোগের বিবরণ লিখতে হয়। এরপর চিকিৎসককে রোগীর লক্ষণগুলো লিখতে হয়। তারপর ডান দিকে আরএক্স চিহ্ন দিয়ে ওষুধের নাম লিখতে হয় এবং নিচে চিকিৎসকের স্বাক্ষর দিতে হয়। আর ওষুধ লেখার সময় ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা ইনজেকশন এটা লিখতে হয়। এটা কত মিলি, ডোজ কতটুকু, খাওয়ার আগে না পরে তা লিখতে হয়। সেই সঙ্গে ওষুধের নামটা অবশ্যই ইংরেজিতে লিখতে হয়। সরকারি হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন এত ছোট যে তাতে সবকিছু লেখাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আলাদা প্যাডের ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন।
২০১৭সালে ব্যবস্থাপত্রে হাতের লেখা নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে কর্তৃপক্ষ একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। কিছুদিন সেটি মানা হলেও আবারো পুরনো ধারায় ফিরে গেছেন অনেক চিকিৎসক। অনেক চিকিৎসক আবার প্রিন্ট করে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম (ওষুধের মূল কেমিক্যাল কম্পোজিশনের নাম) না লিখে ব্র্যান্ডের নাম লিখে থাকেন। এতে পছন্দ অনুযায়ী কোম্পানির ওষুধের নাম লেখার সুযোগ থাকে। অভিযোগ আছে, ওষুধের মান যাই হোক কমিশন বাণিজ্যের অনৈতিক লোভে অনেক চিকিৎসক তাদের পছন্দ অনুযায়ী কোম্পানির ওষুধের নাম লেখেন ব্যবস্থাপত্রে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হন রোগীরা। উচ্চদাম দিয়েও নিন্মমানের ওষুধ কিনতে বাধ্য হন মানুষজন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে কিন্তু গোড়ায় গলদ রেখে কাঙ্খিত সাফল্য পাওয়া যাবে না। একটি আদর্শ চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে কী কী বিষয় থাকা বাধ্যতামূলক, তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। একথা অস্বীকারের উপায় নেই, দেশে চিকিৎসকের বিপরীতে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সঠিক উপায়ে প্রতিটি রোগীর জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে ব্যবস্থাপত্র লেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার পরও ন্যূনতম কিছু বিধান থাকা আবশ্যক। তাছাড়া যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক লেখার প্রবণতা রোধ করা প্রয়োজন। এ-সংক্রান্ত যুগোপযোগী গাইডলাইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন তদারকি জোরদার করতে হবে।
এসডব্লিউ/বিবি/ এফএ/২০২৩
আপনার মতামত জানানঃ