ঢাকা শহরে স্বাভাবিকভাবেই গ্যাস নিয়ে এক বিড়ম্বনা রয়েছে। এর মাঝেও যখন গ্যাস সংকট দেখা দেয় তখন সেটা নির্যাতনের পর্যায়ে চলে যায়। গত দু-তিন বছরে কখনো সমস্যা হয়নি, এমন এলাকাতেও দেখা দিয়েছে গ্যাসের সংকট। কোনো কোনো এলাকায় সারা দিন রান্নার চুলাই জ্বলছে না। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ওই সব এলাকার বাসিন্দারা। গত দুই মাস থেকে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় এ ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীবাসী। এমনিতে পাইপলাইনে কনডেনসেট জমে যাওয়ায় শীতকালে গ্যাসের চাপ ঠিক রাখতে কম্প্রেসার বাড়াতে হয় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। এবার সরবরাহে এই বড় ঘাটতির কারণে রাজধানীসহ আবাসিক থেকে শিল্প গ্রাহকরা গ্যাসের তীব্র সংকটে পড়েছেন। স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি কেনায় সরকারের অনাগ্রহের কারণে এবার এ সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, দেশে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অন্তত ৫২৫ এমএমসিএফডি আমদানিকৃত এলএনজি প্রয়োজন।
সারা দেশে গ্যাস সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাভাবিকের চেয়ে দাম দ্বিগুণ হওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হয়নি। এলএনজির দাম টনপ্রতি ৩০ ডলার বেড়েছে। এ কারণে সরবরাহ লাইনে এলএনজি কম যাচ্ছে।
দাম বেড়ে যাওয়ায় রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেড (আরপিজিসিএল) গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজির দুটি চালান বাতিল করেছে।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ২ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর সঙ্গে এলএনজি সরবরাহ করা হয় আরো ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু গত ডিসেম্বরে এলএনজির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ায় জানুয়ারিতে হঠাৎ করে জাতীয় গ্রিডে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এতে প্রভাব পড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার গ্যাসের আবাসিক গ্রাহক থেকে শিল্পেও। এরপর ফেব্রুয়ারিতে আরো ২০০ মিলিয়ন এলএনজি যোগ করে মোট ৪০০ মিলিয়ন এলএনজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু তাতেও সংকট কমছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে মোট গ্যাস উত্তোলন ও আমদানীকৃত এলএনজি মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট (১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সরবরাহ লাইনে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায়। রাজধানীর আজিমপুর, পূর্ব রাজাবাজার, জিগাতলা, মোহাম্মপুর, আদাবর, ভাটারা, বাড্ডা, গেন্ডারিয়া, তুরাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান, মিরপুরের কিছু অংশ, পল্লবী ও পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকায় সংকট বেশি হচ্ছে।
রাজধানীর আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকার বাসিন্দা পলি বেগম জাতীয় এক দৈনিককে বলেছেন, পরিবারের সদস্যদের জন্যে নাশতা বানাতে গত এক মাস ধরে তিনি ভোর ৫টায় ঘুম থেকে ওঠেন। কারণ প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে গ্যাস সরবরাহ কমতে থাকে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ থাকে না বলে তিনি জানিয়েছেন। তার স্বামী বলেছেন, ‘আমরা বিকেল ৫টায় দুপুরের খাবার খাই।’
পূর্ব রাজাবাজার, জিগাতলা, মোহাম্মপুর, আদাবর, ভাটারা, বাড্ডা, গেন্ডারিয়া, তুরাগ, উত্তর খান, দক্ষিণ খান, মিরপুরের কিছু অংশ, পল্লবী ও পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকার বেশ কয়েকজন অধিবাসী ওই দৈনিককে জানিয়েছেন যে তারা গত কয়েক মাস থেকে তীব্র গ্যাস সংকটে রয়েছেন এবং গত মাসে এই সংকট তীব্রতর হয়েছে।
উত্তর খানের মাতারবাড়ির বাসিন্দা হাসান বলেছেন, ‘গত এক মাস ধরে আমরা তীব্র গ্যাস সংকটে রয়েছি। সকাল ৭টা থেকে গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। সকাল ৯টার মধ্যে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আবার ২টার দিকে গ্যাস আসে। তারা মাঝেমধ্যে কাঠের চুলা ব্যবহার করেন বলেও জানিয়েছেন হাসান।
ঢাকা শহরে গ্যাস সরবরাহ করা তিতাস গ্যাসের গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৪ হাজারের মতো। যে পরিমাণ গ্যাস রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
একদিকে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এলএনজি কেনা স্থগিত, অন্যদিকে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদনও কমে আসছে। এক বছর আগেও গ্যাসের সরবরাহ ছিল ৩ হাজার ১৬৭ মিলিয়ন ঘনফুট। এখন সেখান থেকে আড়াই মিলিয়ন ঘনফুট কমেছে। দেশের খনি থেকে উৎপাদন হ্রাস ও আমদানীকৃত এলএনজি মিলিয়ে মোট সরবরাহ কমেছে ১০ শতাংশ।
উত্তর গোলার্ধের বেশির ভাগ দেশে চরম ঠান্ডা আবহাওয়ায় তাপের জন্য গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে এশিয়ান এলএনজির চাহিদা মৌসুমের প্রত্যাশিত চাহিদাকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে এশিয়ান এলএনজির দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বের বৃহত্তম তিনটি এলএনজি রপ্তানিকারক দেশ মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহের বিঘ্ন এবং উচ্চ পরিবহন খরচ গ্যাসের দামকে আরো প্রভাবিত করছে। এ ঊর্ধ্বগতি সামনের দিনগুলোয়ও অব্যাহত থাকবে বলে পূর্বাভাস বাজার পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর।
এ পরিস্থিতিতে এলএনজির বাজারে উত্থান-পতন থেকে ধারণা নিয়ে আগামীতে গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, গ্যাসভিত্তিক যেসব কলকারখানা গড়ে উঠছে তাতে এলএনজির মতো উচ্চমূল্যের জ্বালানির লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা মনে করেন, এলএনজি নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা দুই বছরের। শুরুতেই স্পট মার্কেট থেকে আমরা কম মূল্যে এলএনজি কিনতে পেরেছিলাম। এখন দাম বেড়ে যাওয়ায় কম কেনা হচ্ছে। তবে শীত মৌসুম চলে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেই মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/বিবি/কেএইচ/১৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ