বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) ছিল এক সময়ের সম্ভাবনাময় উদ্যোগ। গ্রাহকের টাকায় গঠিত এই তহবিলের উদ্দেশ্য ছিল গ্যাস অনুসন্ধান, কূপ খনন, গ্যাসক্ষেত্রের আধুনিকায়ন এবং দেশীয় গ্যাস মজুদের পরিমাণ বাড়ানো। কিন্তু ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ এখন প্রায় নিঃশেষ। প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা জমা হলেও বাস্তবে গ্যাসের মজুদের ক্ষেত্রে দেশ তেমন কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। বরং এই বিপুল অর্থের সিংহভাগ খরচ হয়েছে এমন খাতে, যার সঙ্গে গ্যাস উন্নয়নের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই।
এখানে মূল সংকট শুরু হয় তহবিলের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার অভাব থেকে। জিডিএফ গঠনের নীতিমালার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল—এই অর্থ শুধুমাত্র গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন এবং সংস্কারের কাজে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই তহবিল থেকে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এলএনজি আমদানিতে এবং ৩ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা মোট ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি। এতে করে প্রকৃত উন্নয়ন কার্যক্রম অর্থ সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশের ৫০টি কূপ খননের প্রকল্প বা ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনাও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, কারণ কার্যত অর্থ নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার উদাহরণ নয়—এটি একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম তো একে সরাসরি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ অর্থ তছরুপে যেসব প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে অভিযুক্ত করবে ক্যাব। তার মতে, জিডিএফের মালিক দেশের জনগণ, এবং এটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্তও জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে হওয়া উচিত ছিল।
অন্যদিকে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এলএনজি কেনার জন্য যে অর্থ নেয়া হয়েছে, তা ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা পরিশোধ করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে একবার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে স্থানান্তরিত হওয়া অর্থ ফেরত পাচ্ছে না সরকার নিজেই, সেখানে পেট্রোবাংলার এই আশ্বাস কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? বিশেষ করে যখন বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার নিজেই অর্থ সংকটে ভুগছে।
এখানে একটি রাজনৈতিক জটিলতাও বিদ্যমান। ২০২১ সালে করোনা মহামারীর সময় সরকার আইন করে সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত তহবিল রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেয়ার ব্যবস্থা করে। এই আইনটিই জিডিএফের অর্থ সরানোর একটি বৈধতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গঠিত তহবিল—যার অর্থ জনগণের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে, সেটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ভার মেটাতে ব্যবহার করার নৈতিকতা কতটা আছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল এখন রাজস্ব ঘাটতির সমাধান করতে গিয়ে নিজেই এক ঘাটতির গল্পে পরিণত হয়েছে। এখন এই তহবিলে মাত্র ১ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে, যা দেশের একটি মাঝারি গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতেই অপ্রতুল। অথচ গত চার বছরে দেশের স্থানীয় গ্যাস মজুদ গড়ে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে কমেছে। এর ফলে সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনাও হুমকির মুখে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২০০৯ সালে যখন গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এই তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন জনগণ আশা করেছিল যে দেশীয় গ্যাস খাতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাস্তবে গ্যাসের দাম বেড়েছে, অথচ উন্নয়ন হয়েছে খুবই সামান্য। ২০১৯ সালে আবারও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা করে এই তহবিলে জমা রাখার আদেশ দেয়া হয়, অথচ সেই অর্থের ব্যবহার নিয়ে কোনো জবাবদিহিতা নেই।
এই পরিস্থিতির জন্য কেবল একটি সংস্থা বা ব্যক্তি দায়ী নয়। এটি একটি বৃহৎ প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফলাফল—যেখানে পরিকল্পনার অভাব, স্বচ্ছতার ঘাটতি, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মিলে এক গভীর অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করেছে। জিডিএফ-এর অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার হতো, তাহলে আজ বাংলাদেশের গ্যাস মজুদ আরো সুসংহত হতো, এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমত, এবং বিদেশি মুদ্রার চাহিদাও হ্রাস পেত।
অবশ্য এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। সরকারের উচিত হবে জিডিএফ ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ করা, তহবিল ব্যবহারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা, এবং জনগণের টাকায় গঠিত এই তহবিল জনগণের কল্যাণেই ব্যবহার নিশ্চিত করা। জ্বালানি খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য স্বল্পমেয়াদি আমদানি নির্ভরতা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগই হতে হবে মূল কৌশল। এজন্য প্রয়োজন জবাবদিহিমূলক এবং নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো, যা এখনো অনুপস্থিত।
এই বাস্তবতা আমাদের একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়—জনগণের অর্থ নিয়ে গঠিত উন্নয়ন তহবিলগুলো আসলে কার? সরকারের? নাকি জনগণের? এবং যদি তা জনগণেরই হয়, তবে কেন তা ব্যবহারে জনগণের সম্মতি ও স্বার্থ উপেক্ষিত হয়? এই প্রশ্নের উত্তরই হয়তো নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তার গতিপথ।
আপনার মতামত জানানঃ