অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি, আধুনিক জীবনযাত্রা, ভালো উপার্জন আর সাংস্কৃতিক মিল থাকায় নিরিবিলি বসবাসের স্বপ্ন নিয়ে প্রতি বছর মালয়েশিয়ায় যান অসংখ্য কর্মী। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ফের উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা জাগাচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরই মধ্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি শ্রমিক নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। ওই প্রস্তাবনায় ‘কতসংখ্যক এজেন্সি কর্মী পাঠাবে’ তা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কবে বাংলাদেশিদের জন্য খুলবে, কোন প্রক্রিয়ায় কর্মী যাবে; তা নির্ধারণে আগামী মঙ্গলবার দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সভা হবে।
সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজার খোলার সঙ্গে সিন্ডিকেটের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের পদত্যাগের পর গত মার্চে মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় ফেরা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও বাংলাদেশি কয়েকজন জনশক্তি ব্যবসায়ী মিলে আবারও সিন্ডিকেট গড়ার চেষ্টা করছেন। এতে সাধারণ এজেন্সি মালিকদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, ২০১৬ সালের মতো হাতেগোনা কয়েকটি এজেন্সিকে নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটই কর্মী পাঠানোর কাজ পেতে যাচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে বলেন, কারও ব্যবসায়িক স্বার্থ নয় দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে সরকার। যে পদ্ধতিতে কর্মীরা কম টাকায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিরাপদে কাজ করতে পারবেন, সেভাবেই কর্মী পাঠানো হবে।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টায় অনলাইনে জেডব্লিউজির সভা হবে। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ মুখ্য সহকারী সচিব সালিনা মোহাম্মদ সালি লুডিন ইমেইলে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনের সভার যে আলোচ্যসূচি পাঠিয়েছেন, তাতে চারটি এজেন্ডা রয়েছে। এক নম্বরেই রয়েছে কতসংখ্যক এজেন্সি কর্মী পাঠাবে, তা নির্ধারণ। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে কর্মী নিয়োগের অনলাইন পদ্ধতি, বিদ্যমান সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ শেষে নতুন চুক্তি এবং নতুন সমঝোতা স্মারক সইয়ের তারিখ।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে গত এক যুগের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিবারই কর্মীরা প্রতারণা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১২ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় (জিটুজি) কর্মী নিতে রাজি হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি সফল না হওয়ায় ২০১৬ সালে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যুক্ত করে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে দুই দেশ সমঝোতা স্মারক সই করে। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি এর মেয়াদ শেষ হবে।
মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র দেওয়ার কাজ পায় সিনারফ্ল্যাক্স নামের একটি মালয় কোম্পানি। বাংলাদেশের এক হাজার ৩০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাত্র ১০টি আমিন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, ক্যারিয়ার ওভারসিস রিসোর্স, আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, শানজারি ইন্টান্যাশনাল, রাব্বি ইন্টান্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, আল ইসলাম ওভারসিস এবং প্রান্তিক ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্মী পাঠানোর কাজ পায়। এই ১০ এজেন্সি পরিচিতি পায় ‘সিন্ডিকেট’ নামে। এসব এজেন্সির কয়েকটি ছিল ওই সময়ের কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপির পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।
জিটুজি প্লাসে ২০১৭ সালের মার্চে কর্মী পাঠানো শুরু হয়। পাঁচ বছরে ১৫ লাখ কর্মী পাঠানোর ঘোষণা থাকলেও দুই বছরে পৌনে তিন লাখ বাংলাদেশি এ পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় যান। কর্মীপ্রতি অভিবাসন ব্যয় সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার নির্ধারণ করা হলেও একজন কর্মীও তিন লাখ টাকার কমে যেতে পারেননি। দুর্নীতির জন্য এই পদ্ধতি দু’দেশেই সমালোচিত হয়। ২০১৮ সালে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় ফেরার পর তদন্তে জানা যায়, জিটুজি প্লাসে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। দুই দেশের সিন্ডিকেট এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ কারণে জিটুজি প্লাসে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া।
সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা সমকালকে জানিয়েছেন, গতবার মালয়েশিয়ায় অনিয়মের হোতা ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী দাতো শ্রী আমিন নুর ও তার সহযোগী বাংলাদেশি এজেন্সি মালিকরা। তাদের সঙ্গে মদদদাতা ছিলেন সেই সময়কার মালয়েশিয়া সরকারের মন্ত্রী ও তাদের ঘনিষ্ঠরা। গত মার্চে মালয়েশিয়ায় মহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এসেছে। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় থাকা ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএও) এ জোটের মূল চালিকাশক্তি। অভিবাসন খাতের যে ব্যবসায়ীরা মাহাথিরের সময় কোণঠাসা ছিলেন, তারা এখন শক্তিশালী। রাষ্ট্রীয় শক্তির ছত্রছায়ায় তারাই নতুন করে সিন্ডিকেট করার পাঁয়তারা করছেন। তা ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে ‘সিন্ডিকেট নির্মূল ঐক্যজোট’-এর ব্যানারে এরই মধ্যে তারা আন্দোলনে নেমেছেন জনশক্তি ব্যবসায়ীরা।
জোটের আহ্বায়ক আলী হায়দার চৌধুরী বলেছেন, দুর্নীতির কারণে যে পদ্ধতি বাতিল হয়েছিল, সেই একই প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানোর চেষ্টা চলছে। এতে আবারও কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ইস্টার্ট বে বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বাবুল বলেন, ওরা (মালয়েশিয়া) ২৫ অথবা ৩০ লাইসেন্সটা দিয়ে লোকবল নেবে। শ্রমিকরা এক লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে সেখানে যেতে পারবে। দেশটির কৃষি ও নির্মাণ খাতে প্রায় ৬ লাখ লোক পাঠানো যাবে। শহিদুল ইসলাম নামে এক মালয়েশিয়া প্রবাসী বলেন, ৯৫ শতাংশ মালয়েশিয়ান প্রবাসীর ভিসা শেষ হয়ে গেছে। আমরা সরকারিভাবে সেগুলো অটোভাবে রিনিউউ করতে হবে।
বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন তাদের বৈধ করার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে করোনার কারণে যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। তবে, এবারের সুযোগ কাজে লাগাতে সিন্ডিকেটের ব্যাপারে সচেতন থাকার পরামর্শ তাদের।
সরকারি হিসাবে, সর্বশেষ ২০১৮ সালে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার। কিন্তু ওই বছরই সেপ্টেম্বরে দেশটির নতুন সরকার কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় এবং গত বছরজুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে সেখানে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা ছিল নামমাত্র। আবার দেশে ছুটি কাটাতে এসে সেখানে কর্মরত প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি করোনার কারণে আটকে রয়েছেন। এসব কর্মী এখন দিন গুনছেন ফিরে যাওয়ার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য আবার খোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মী পাঠানোর যে প্রক্রিয়া, তার নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাওয়ার পুরোনো শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। সব এজেন্সি কর্মী পাঠালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে বলে যে অজুহাত দেখানো হচ্ছে, তা ঠিক নয়। সৌদি আরবসহ অন্যান্য শ্রমবাজারে সব এজেন্সিই কর্মী পাঠায়। সেখানে বিশৃঙ্খলা হয় না; বরং ১০-১৫ এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠালেই বিশৃঙ্খলা হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ